কিস্তি::৯১ জোছনা দর্শন ও একজন হুমায়ূন আহমেদ

জোছনায় ভেসে যাচ্ছে সেন্টমার্টিন।  উত্তরপাড়ায় বসে আছি।  হোটেল ফেরার কোনো ভাবনা নেই। সমুদ্রের উতল হাওয়া আমাকে টানছে; ইচ্ছে করছে ছুট দেই নীলাভ জলের অন্তহীন জলে!

সেন্টমার্টিনে কখনো জোছনাকে মনে করে যাইনি। সেবার জোছনা পেয়েছিলাম কাকতালীয়ভাবে। আমার সাথি ছিল বাবু।  বছর চৌদ্দ আগের রাত।  পড়ি সেকেন্ড ইয়ারে।

ট্যুরের প্রতি ছিল প্রচণ্ড টান। সুযোগ পেলেই ছুট দিতাম।  প্রবালের ওপর বসে  সমুদ্রের বুকে চোখ রেখে সমুদ্র দেখার অসাধারণ অভিজ্ঞতা; এ সব কাব্য কবিতা করে বোঝানো ভারি মুশকিল।

সেন্টমার্টিন সে সময় এত গিঞ্জি ছিল না। মানুষ কম ছিল, পর্যটক তারচে কম।  আমার জীবনে জোছনা উপভোগের সবচেয়ে আনন্দময় একটা রাত সেটি। সাথে সেই গান... এক জোনাকী দুই জোনাকী!

দ্বিতীয় জোছনা উপভোগ করেছিলাম সুন্দরবনে।  ফেব্রুয়ারি মাসের দিকের ঘটনা। সালটা ২০০৪।  সাথি ছিল মীর মামুন, মিটি, সাদিয়া, লিপি, সামিউল হক  এবং মঙ্গা আমানত।

জাহাজটা ভিড়েছিল হরিণটানায়। সুনসান নীরবতা।  বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের নোনা জলের ওপর জোছনাটা যেনো আমার ছেলেদের মুখ। এত উজ্জ্বল। জোছনা রাতে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। জোছনা প্রীতি আমার কীভাবে যে জন্মালো তা নিয়ে নিশ্চিত  কোনো ইতিহাস নেই।

হরিণটানায় জাহাজের ছাদে বসে গল্প করছি, শুনছি সেখান থেকে বাঘের মানুষ নিয়ে যাবার গল্প। তবুও এমন একটা ঘোরলাগা জোছনা ভেজা রাতে আমরা নামবো না সেখানে ; হতে পারে না।

 জাহাজের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে নামলাম হরিণটানায়।  ফরেস্টের লোকদের থাকার ক'টা ঘর। তারপর ঘোর বন। যে বনের ভেতর তাকে  বাঘ; সাপ আর আর কত রকমের জীব। সুন্দরবনে আমার কাছে সবচেয়ে আকষর্ণীয়  হলো  বন। এত বৈচিত্রময় সবুজ বন আমার চোখে লেগে থাকে।

 সে বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে জোছনা দেখার অনুভূতি  আসলে অব্যক্ত। এটা কেবল অনুভব করা যায়। শীতের শেষ দিক, তবুও  গরম কাপড় ছিল।  বনের কাছে শীত একটাু বেশিই বটে। আমরা কাঁপছিলাম। কিন্তু ফিরতে চাইলাম না। হরিণটানার ফরেস্ট বাংলোর সামনে কাঠের   টুলে বসে আড্ডা  চলছিলো। আর ফরেস্টের একজন রক্ষি শোনাচ্ছিলেন- কবে  এখান থেকে কাকে  বাঘ ধরে নিয়ে গেছে; তাদের হাঁড়গোড় উদ্ধারের কাহিনী। কিন্তু ঘোরলাগা বনে মায়াবী জোছনার কাছে এ জীবন তুচ্ছ!

জোছনার রাতে নদীর  ঢেউ আর সেই  সাথে অনবদ্য রাত।  এত আনন্দময় রাত জীবনে আরেকটা আসতে পারে না।

তৃতীয় জোছনা দেখার ঘটনা এসএম হলে। যদিও আমি বঙ্গবন্ধু হলে থাকতাম কিন্তু শামীমের সুবাদে; সেখানেও আমার থাকা পড়তো। আমাদের আড্ডার সাথি ছিল সাইমুম ভাই।  এক  শীতের একটা  জোছনা রাত আমরা আড্ডা দিয়ে এসএম হলের মাঠেই কাটিয়ে দিলাম; সেটি সম্ভবত ২০০৫ এর ঘটনা।

ছোটবেলায় আমার জোছনা দেখার সাথী ছিল ফারুক। সম্পর্কে আমার চাচা। কিন্তু বড় হয়েছি একসাথে। আমার  অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন। আমরা একসাথে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তাম। এর কাছ থেকে ওর  কাছ থেকে ধার এনে পড়া হতো। আবার নিজেদের কেনা বইও ধার দেয়া হতো । এভাবেই । এ সব বইয়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল; জোছনা প্রীতির পেছনে।

ফরুক আর আমি বের হলাম জোছনা দেখতে।  বর্ষার রাত।  মেঠো পথ ধরে হাঁটছি। তখনো আমাদের গ্রামে কারেন্ট আসেনি।   কেরোসিনের বাতি জ্বলছে।  তখনো সেটি গ্রাম; দূরে দূরে কিছু বাড়ি।   উত্তর দিকে হাঁটলে সেখানে একটা পাইপ ; যেটি রাস্তার দু’পাশের পানি সরানোর কাজ করতো। সেখানেই  আমাদের অনেক আড্ডায় কেটে যেতো সময়। সে রাতেও আড্ডা হলো।  চাষ দেয়া জমির ঘোলা জলে আমরা উপভোগ করলাম অনবদ্য এক জোছনা।

এখন সময় পাল্টে গেছে। জোছনা দেখার মত সুযোগ হয় না। কবে যে জোছনা সেটাই দেখা হয় না।  সময় এমন কেনো?

জানি না।  তবে এ দেশে জোছনা কে যিনি জনপ্রিয় করেছেন; তিনি হুমায়ূন আহমেদ। প্রকৃতির এ অসাধারণ রূপটি তিনি সবার সামনে নিয়ে এসেছেন। তাকে কৃতজ্ঞতা। আগামীকাল সে মানুষটির জন্মদিন।  শুভ কামনা তাঁর  জন্য।



বাঁধন থেকে ভাগ্নি; শিক্ষা শান্তি প্রগতির কদর্য রূপ




নারী জাতির প্রতি তাদের অপরিসীম  শ্রদ্ধা।  শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি তাদের মূল নীতি। কিন্তু দুটো ঘটনা আমাকে খুব আহত করেছে। আমার মত একটা লোকের আহত হওয়া বড় কোনো ঘটনা না; কারণ এ সমাজের  সাদা মাইক্রো বাস দেখলে যাদের বুক ধুকফুক ধুকফুক করে তাদের মধ্যে আমি নাই। আবার আছিও। কারণ মানুষ হাওয়া হওনের জন্য কোনো কারণ লাগে না।  তবুও ঘটনাটা আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের বলে  লিখছি-


২০০০ সালের ঘটনা।  আমার তখন সেকেন্ড ইয়ারে।  বর্ষ বিদায়  নিয়ে টিএসসি সরগরম।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই উৎসব-উচ্ছ্বাস-বাধ ভাঙ্গা আনন্দে  মেতে ওঠা। সেই মেতে ওঠার কিছু দিনে অনেকেই আসেন। যাদের আমরা ' বহিরাগত' হিসাবে চিহ্নিত করছি এখন।  আবার অনেককে আমরা নিয়ে আসি, আমাদের প্রয়োজনে। সেই প্রয়োজন ব্যাক্তিগত, রাজনৈতিক, জৈবিক কিম্বা শ্রদ্ধাবোধের।

নারী- শব্দ আমাদের কাছে সব সময় শ্রদ্ধার বাইরে কিছু শব্দ-ঘ্রান নিয়ে আসে। যেখানে শিক্ষা-শান্তি- প্রগতির বাইরের  বাংলাদেশ- জিন্দবাদঅলারও আছেন।  যেহেতু জিন্দাবাদ একটি পাকি শব্দ সেহেতু আমরা তাদের পাকি বর্বরদের  সাথে মিলিয়ে নিয়ে সে আলোচনা বাদ দিতে পারি।

কিন্তু যারা খাঁটি  বাংলা শব্দ ও প্রগতির ধারক তাদের কিছু  বিষয় আমরা চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে গেলেও  দু একটা বিষয় একেবারেই এড়াতে পারি না।

 খুব লজ্জা নিয়ে বলছি, ২০০০ সালে বাঁধনের কাপড় খুলে নেবার পর ২০১৪ সালে  আরেকজন নারীর সালোয়ার কামিজ ছিঁড়ে ফেরার মত যে দুবৃত্তপনা  শিক্ষা-শান্তি- প্রগতির লোকেরা করেছে বলে প্রমাণিত হলো সেটি খুবই কষ্টের।


 পিছিয়ে পড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পেছনে যারা কাজ করছেন; যাদের কাজের মধ্যে শিবির ঢুকে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে তাদের সাংগঠনিক নেত্রী অভিযোগ করছেন; তারা খুবই সুশীল এবং প্রগতিশীল  তারা এমনটা  কেনো করলেন বুঝতে পারি না।


জৈবিক তাড়না সবারই আছে।  ক্যাম্পাসে নিজর ক্ষমতা দেখানোরও অনেক জায়গা  আছে। সেটি না করে এ রকম নিরীহ নারীর ওপর ওপর তারা কেনো হামলে পড়েন, তা জানি না।


২০০০ সালে বাঁধনের কাপড় টেনে নেয়া এবং নিষ্পেষণ করে তাকে অসুস্থ করে ফেলারা শিক্ষা-শান্তি- প্রগতির দলের লোক বলে সে সময় খবরের কাগজে পড়েছিলাম।  এখনো সেই একই লোক। সে সময়ও আম্লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। এখনো তাই। সে সময় আজাদ চৌধুরী স্যার ভিসি ছিলেন, এখন আরেফিন স্যার। দুজনই ক্যাম্পাসে অতিব সুন্দর কথা বলে মানুষকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতাবান।


 তাহলে এমন হয় ক্যানো, কোন শিক্ষা এরা লাভ করেছেন যার জন্য ক্যাম্পাসের পবিত্র ভূমি অপবিত্র হয়,  নারীর শরীরে হাত ওঠে। একেবারেই ব্যাক্তিগত কারণে।

এটা কোন প্রগতি, যে প্রগতি নারীর শরীরের কাপড় টেনে নেয়। হামলে পড়ে হায়েনার মত। তারপরও এ প্রগতিশীলদের পক্ষে কথা বলার  লোকের অভাব থাকে না। তারা যখন কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর আন্দোলনে হামলা করে আমরা তখন বলি- যারা আন্দোলনে ঠেঙ্গানোতে জগতের সব  পুণ্য। তাই আসো। ঠেঙ্গাই।


 আবার তারা যখন বিরোধি দলে থাকে, তখন কথার  ধরণ বদলে যায়, সহ অবস্থান, ছাত্রদের অধিকার, সামনে এগিয়ে যাবার নানা প্রেরণা ময় বক্তব্য দেয়। এ সব শুনে শুনে দেড় দশক পার করেছি। লেখা একবারেই ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।

অনুসিদ্ধান্ত: এটা  সবাই বলেন, আমিও বলছি ২০০০ সালে বাঁধনের ওপর হামলার বিচার হলে  ২০১৪ সালের এমন ঘটনা ঘটতো। ২০০০ সালের হামলাকারীওরা কার্জন হল এলাকার ছিল; এবারের হামলাকারীরাও। ঘটনাস্থ কেবল ভিন্ন- ২০০০ সালে টিএসটির রাজু স্মৃতি ভাস্কার্যের সামনে; ২০১৪ সাল কার্জন হল পুকুর পাড়।