কিস্তি :: ৮৮:: ভার্জিন ড্রিংকস,পুরনো ঢাকা এবং তেহারি সমাচার



ঘোড়ার গাড়িতে করে পুরনো ঢাকার বাংলা বাজারে যেতাম। এখনো যাই। তবে কুবই কম।  আগে ভাড়া ছিল ৫ টাকা। এখন ২০ টাকা। তাতে কী। এই একটা ভ্রমণ আমার কাছে উপভোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমার প্রথম রোজগার ছির বাংলা বাজার কেন্দ্রিক।

নোট বই , গাইড বই লিখতাম। ভালোই ইনকাম ছিল। ঘটনাটা এ রকম- আমি  ঘুমিয়ে আছি। পাঞ্জেরীর প্রকাশণীর নেসার ভাই  আনিস ভাইয়ের সাথে ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত সব ক্লাশের বইয়ের নোট তৈরির আলাপ করছিলেন। তার কথার উচ্চ স্বরে আমি মশারী ফাঁক করে  দেখলাম। 

আনিস ভাই পরের দিন আমাকে কিছু কাজ দিলেন। একটা বাংলা বইয়ের পুরো নোট ঘন্টা দেড়েকে বানিয়ে দিলাম।  আমার লেখা তার ও নেসার ভাইয়ের পছন্দ হলো।  তারপর আমি লিখতে শুরু করলাম। তবে প্রকাশনার কাজে জড়িয়ে যে সব বিষয় বেশি  সঙ্কটে পড়তাম তা হলো প্যামেন্ট। এখনো স্কলার্স পাবলিকেশন্সের কাছে আমার হাজার পঞ্চাশেক টাকা বাকি পড়ে আছে।
সেই ২০০১ সাল। আর এখন ২০১৪। টাকা দেবো, দিচ্ছি করে ঘুরিয়েছেন, পরে আর  যাইনি।

তবে লেখালেখির বিষয়ে আর্থিকভাবে সবচেয়ে সৎ  আবদুৃল্লাহ অ্যান্ড সন্স। আমি তাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো স্নাতক শ্রেণীর বই এডিট করে দিয়েছিলাম। এক হাতে কপি নিয়েছে, আরেক হাতে টাকা দিয়েছে।

টাকা নিযে গড়ি মসর কারণে পরে আর লেখা হয়নি। সে সসময়  যাত্রাবাড়ি ও পরে বকশিবাজার থেকে  পুরনো ঢাকার বাংলা বাজারে যেতাম ঘেড়ার গাড়ি করে। বাস চলতো- মুড়ির টিন। এক টাকায় যাওয়া যেতো গুলিস্তান থেকে সদরঘাট।  এতটা কঠিন যানজপট ছিল সেই ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত, সে সময়টা বাসে  গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা, কখনো আরো বেশি সময় লাগতো। এখন কেমন অবস্থা জানি না। কালন আমি এখন যাই শুক্রবারে!

পরে অবশ্য বকশিবাজার থেকে  আরমানি টোলা হয়ে শটকাটে ২০ থেকে ২৫ টাকা রিকশা ভাড়ায় চলে যেতাম। এভাবে অনেক দিন গেছি। সেখানে যাবার সুযোগে পুরনো ঢাকার সাথে আমার একটা আত্মিক  সম্পর্ক।

শাঁখারি বাজারে গেলাম ২০০০ সালরে দিকের এক বিকালে। আমাদের এলাকার এক বন্ধু পিংকুর সাথে। ওর বোন থাকতো সেখানে। ভাগ্নি নাচ  শিখছে, মামাদের নাচ দেখাবে, তাই যাওয়া। একটা সরু গলি ধরে আমরা ভিতরে ঢুকছি, আর মনে হচ্ছে আমি গুহার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছি। আমি একটু মোটাসোটা ছিলাম, তাই  সরাসরি ঢুকতে পারিনি, একটু  পাথালি হয়ে ঢুকতে হলো। সেখানে আলো ছাড়া একটা মিনিটও কাটে না কারো।

অনেক্ষন ছিলম, মিষ্টি খেলাম। ভাগনির নাচ দেখলাম এবং তার সঙ্গীত প্রতিভার কিঞ্চিত দেখে ফিরে এলাম। এভাবে পুরনো ঢাকা-

সে সময় আমি  ওযারীর আল আমিন কোচিংয়ে ক্লাস নিতাম। গিযে দেখি সব মেয়ে। ওই কোচিংয়ে কোনো ছেলেকে পড়ানো হতো না।  আমার ক্লাস নেয়ার কথা বাংলা, ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানে। সেটি ইন্টার থেকে ডিগ্রির মেয়েদের। কিন্তু অনেক টিচার আসতেন না। তাই আমাদক বদলি খাটতে হতো। নাইট টেনেও পড়িয়েছি।   

কোচিং চালাতে 'সায়াদাত' ভাই। তিন বললেন- আমি যাওয়ার কারণে তার শিক্ষার্থী বেড়েছে।  আমার বিশ্বাস হলো না। পরে আমি  যখন ছেড়ে আসি, উনি খুব মন খারাপ করেছিলেন।  সায়াদাত ভাইয়ের স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছেন বা তিনি  তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। যাকে ভদ্র সমাজে  ডিভোর্স বলে। উনার একটা সন্তান ছিল। মাঝে মাঝে তিনি  ক্লাসের ফাঁকে তার কাছে ছুটে যেতেন।

কোচিংয়ের সুবাদে আমার দুজন নারীর সাথে ভালো সম্পর্ক তেরি হয়েছিল। তাদের একজন নীলা। আরেকজন ঝুনু।  নীলা হালকা পাতলা। আর ঝুনু অনেক মোটা। তবে দুজনই ফর্শা- সুন্দরী।  তারা আমার ক্লাশের ছাত্রী না হয়েও আমার লেকটচার শোনার জন্য আসতেন! (নিজেদের কেমন  মফিজ মনে লইতাছে!)

নীলা মেয়েটা ইভটিজিংয়ের শিকার হতো, সেটি জানার পর একটা 'ব্যবস্থা' করেছিলাম। দক্ষিণ মুহসেন্দীতে ওদের বাসা। বার কয়েক  দাওয়া করেছিল, কিন্তু ভভঘুরে  কুদ্দুসের সময় কই! যাওয়া হয়নি।
ঋষিকেশ দাস লেনে ছিল ঝুনুদের বাসা। ওর মা বাবা বেশ কয়েকবার বলেছিল পুররো ঢাকার  অতিথি আপ্যায়ন কেমন? তা দেখার  সুযোগ নিতে। আমি পারিনি।

আল আমিন কোচিংয়ের চাকুরীটা ছাড়ার আগেই আমার প্রথম আলোর  প্রদায়ক সংবাদদাতার কাজটা জুটেছিল।  আমি সব সময় কাজের মধ্যে থাকি। নট কাম!  কাজ না থাকলে ভালো লাগে না।  প্রথম আলোর হয়ে কাজ করার সূচনার ফাঁকে রাজীব ভাই বললেন, আপাতত পেজ বেরুচ্ছে না।  তাহলে আমার কী করণীয়!

প্রথম আলোর ৫ নম্বর পাতায় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো- প্রিয় মুখ নামে একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন বের হবে।  রাজীব ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে সেখানে যোগ দিলাম। অনেক দিন সেখানে কাজ করেছি।

আমার কিছু অদ্ভূত ঘটনা আছে। তার দুটো প্রিয় মুখে থাকার সময়- আমি ভাবলাম দিনের ১০ টা থেকে রাত ১০  পর্যন্ত  পানি খাবো না। দেখি কাজটা করা যায় কিনা।  তাই হলো।  সে সময় ইয়ুথ গ্রপ একটা পানীয় বাজারে আনে- নাম  দেয় ভার্জিন। সম্ভবত আমি সেই ব্যাক্তি যে সবচেয়ে বেশি ভার্জিন ড্রিংকস খেয়েছি।

মাস চারেক ভার্জিন ড্রিংকস খাওয়ার পর কমিয়ে আনতে বাধ্য হলাম।  দিনে মাত্র দুই লিটার! কারণ আমার পানীয়ের খরচ  দিতো প্রিয়মুখ কর্তৃপক্ষ। আর খাবার আসতো এলিফ্যান্ট রোড়ের  টেস্টি খাবার ঘর থেকে। সেখানে তারা আমার নামটা বদলে দিয়েছিল। নতুন করে রেখেছিল- ' খাইন্না ভাই'।

আরেকটা ঘটনা- আমি সে সময় আজিমপুরের নিউ পল্টনে একটা মেসে উঠলাম। সেই মেসে আমার রুমমেট হিসাবে নিলাম কায়সার ভাইকে। দেয়ালে পোস্টার লিকে তাকে পাওয়া! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্সের একটা সাবজেক্ট থেকে পাস করে চাকুরীর খুঁজছেন। দুজন মিলে থাকি, ভালোই কাটছে। কিন্তু কায়সার ভাই বাইরে থাকেন, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না। আমারো একই হাল।তাই বুয়া মুক্ত মেস! 

 যেহেতু বাইরেই খেতে হবে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একমাস টানা চলবে তেহারি এবং বিরিয়ানী । নীলক্ষেতের তেহারির সুনাম আছে।  চেষ্টা করলাম এবং সফল হলাম। ঠিক একমাসের শেষ দিন বাড়ি গেলাম।  বিকাল ৫ টার দিকে খেতে বসলাম- এক মাস পরে ভাত!  তাও আবার মায়ের হাতে! সে কী সুস্বাদু। চার প্লেট ভাত খাওয়ার পর মনে হলো- পেটে আর জায়গা হবে না। তৃপ্তিতে ডুবে আছি।

কিস্তি :: ৮৭:: প্রিয় ক্যাম্পাস, শিক্ষক ও শিক্ষক রাজনীতি



আমার জীবনের যত প্রাপ্তি, যত আনন্দ, যত সুখ, যত ভালোবাসা, যত অর্জন- সব কিছুর পেছনেই আমার  প্রিয় ক্যাম্পাস- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

৭  বছরের ক্যাম্পাস জীবনে  মানুষজন আর তাদের  ভেতরকার মন সম্পর্কে জানার অফুরন্ত সুযোগ পেয়েছি! তার সবই ঠিক, এটা কোনোভাবেই আমি দাবি করবো না।

আমার এখনো মনে আছে, শাহবাগে বারডেম হাসপাতালের সামনের পেপার বিক্রেতার হাতে ধরা জনকণ্ঠ পত্রিকার কথা, যার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় একটি খবর- জ্ঞান তাপস আবদুর রাজ্জাক আর নেই। লেখাটা আমার বুকের ভেতর বিঁধলো।  একটা বড় রকমের ধাক্কা খেলাম।

তখনো রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে সেভাবে জানা হয়নি। ডিপার্টমেন্টে দু চারবার তার নাম শুনেছি। তার লেখা বই আছে কিনা সেটি জানার চেষ্টা করছিলাম, পাইনি। পরে জেনেছি তার কোনো বই বের হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বাংলাদেশের যে বিকাশ সেটির পেছনে যে মানুষটিকে কঠিনভাবে মানা হয় তিনি রাজ্জাক স্যার।  আমার সবচেয়ে আনন্দের জায়গা ছিল- এই ক্যাম্পাসের 'মাস্টোর' কারা ছিলেন, তা জানার চেষ্টা করা।

সরদার ফজলুল করিম স্যারের  সাথে আলাপে এবং রাজ্জাক স্যার সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা থেকে জানার চেষ্টা করলাম- তাতে রাজ্জাক স্যার চেয়েছেন পণ্ডিত ব্যাক্তিরাই এ ক্যাম্পাসের 'মাস্টোর' হিসাবে কাজ করুক। সে জন্য তিনি 'মস্টোর' সংগ্রহ করে বেড়াতেন।

তার সে চাওয়ার কারণেই হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের বাইরে ভালো মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সত্যেন বোস, গোবিন্দ দেব, রাজ্জাক কিম্বা শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, দেওয়ান আজরফ স্যারের মত শিক্ষকরা এ ক্যাম্পাসে আলো ছড়িয়েছেন।

সেই ক্যাম্পাসে এখন যারা শিক্ষক তাদের নিয়ে অনেক তর্ক আছে। অনেক রকমের নেতিবাচক ভাবনা আছে। সেটি খোলাসা করে দেখার সুযোগ হয়েছে ক্যাম্পাস জীবনেই।

আমাদের শিক্ষকরা যতটা না গবেষণা, পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত তার চেয়ে বেশি দলীয় কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন।  বঙ্গবন্ধু বড় না জিয়া বড় সে আলোচনাই এখানে মুখ্য। বাম রাজনীতির সাথে জড়িতরা  গোলাপী শিক্ষকরা এখনো  আছেন তাদের পুরনো থিওরিতে। মার্কস- অ্যাঙ্গেল-মাও-লেলিন নিয়েই তাদের রাজ্যের চিন্তা। চে কে নিয়ে তাদের ভানার অভাব। কারণ সম্ভবত চে পুরো মাত্রায় বিপ্লবী।

তবে এ সবের বাইরে একদল আছেন কেবল কামাগুনে পোড়ার মতলবে। এমন একটি ডিপার্টমেন্ট নেই যে ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষকও এ কাজটি করেননি। এটা খুবই হতাশার হলেও 'নেতিবাচক' বলে মন্তব্য করতে চাই না। এর কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার কয়েকটি তরিকার একটি সেক্সচুয়াল রিলেশন।

নারী পুরুষ দু রকমের শিক্ষকের মধ্যে এ প্রবণতা আছে। তবে পুরুষ শিক্ষকদের শিকার সম্পর্কে আমরা অনেক সময় জেনে থাকি। নারীদের সম্পর্কে জানা যায় না। কারণ বলা মুশকিল।

তবে এ সব জানাজানি হয়, সাধারণ 'সব দেওয়ার' পরে যদি কাঙ্খিত নম্বর না পাওয়া যায়। মানে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট না হওয়া যায়।  এ রকম কিছু ঘটনা  বিশ্লেষণ করেই আমার এ অনুসিদ্ধান্ত।

 আবার ক্যাম্পাসে অনেক মেয়ে শিক্ষকদের স্ত্রী হয়ে ক্যাম্পাসের অংশ হয়ে থাকতে চান। এ অভিযোগ পুরনো। তবে সেটি অনেকে মানতে চান না। মিথিলা তাদের একজন। এখন বুয়েটের শিক্ষকতা করে। তাকে আমি প্রসঙ্গটা তুলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বলেছিল, নিজ যোগ্যতায় ক্যাম্পাসের অংশ হতে পারা উচিৎ। আমিও তার সাথে দ্বিমত করি না।

 তবে জ্ঞানের এ অভয়ারণ্যে অনেক শিক্ষক জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি স্ত্রী-নারী সঙ্গ উপভোগ বঞ্চিত হয়ে হাতের কাছে যা পান;  তা নিয়ে আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করে থাকেন, এ নিয়ে  সঙ্কট চলে।

কেবল ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে অন্তত ১০ টি অভিযোগ লিখিতভাবে উত্থাপন করা হয়েছিল, এর সবই যৌন হয়রানির। এখানে উর্দু- ফারসি-বাংলা-ইতিহাসের শিক্ষক যেমন ছিলেন, তেমন সাংবাদিকতা, প্রাণীবিজ্ঞান কিম্বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষকও অভিযুক্ত হয়েছেন।

 অনেকে শাস্তি ভোগ করেছেন। আমার সাংবাদিকতার একজন গুরু স্থানীয় মিলান ফারাবী। তিনি সব সময় একটা কথা বলতেন- প্রত্যেক প্রতিভার কোনো না কোনো বিকৃতি থাকে। সম্ভবত এটা তারই অংশ।

তবে শিক্ষক রাজনীতি, ভোট বৃদ্ধি এবং দলীয় কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য  যে পরিমাণ শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছে আগে, এখনো পাচ্ছে সে জায়গা লজ্জার। অপমানের। কিন্তু আমরা সব সময় নিজেদের সুবিধা বিবেচনা করে বিরোধীতা-বর্জন বা গ্রহণের নীতি অনুসরণ করায় তার কোনো সমাধান হচ্ছে না।

একটা ঘটনা বলি- তাহলে রাজনীতির নোংরা রূপটা বোঝা সহজ হবে।  ২০০৩ সালের ঘটনা, সম্ভবত। আইন বিভাগের একজন শিক্ষককের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।  তিনি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।  দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করে কেবল মাত্র সরকারি দলের হওয়ায় সে সময় নিয়োগ পেয়েছিলেন। তবে তার আচরণে নীল দলেরই অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন।  তাই তিনি অনেকটা বিদ্রোহ করে বসলেন।  

 বাস মালিক ওই শিক্ষককে পরে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়। এক সময় ছাত্র রাজনীতি করতেন, তাই সহজেই ক্যাম্পাসে কিছু গুটি চালাতে শুরু করলেন। আমাকে ফোন করে  টিএসসি থেকে তুলে নিলেন। বললেন আলাপ আছে। গেলাম। দেখি গাড়ি কাকরাইল হয়ে শেরটানে ঢুকছে।

তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছি, কিন্তু নামটা তো পত্রিকায় এসেছে সে জন্য তিনি আমাকে খাওয়াতে চান। তার মতে আলোচনায় আছেন তিনি, এটাই বড় কথা।

রাতের খাবারের পর বললেন , 'আমি কাল ভিসি ফায়েজের কাছে যাবো, গিয়ে একটা লাত্থি মেরে তার চেয়ার সহ উল্টে দেবো। ' আমি হাসলাম। কারণ হলের ক্যাডারি ভাব এখনো তার যায়নি বলে মনে হয়েছে। তিনি বললেন হেসো না। সত্যি করবো।

তার পরে প্রায় ফোন করতেন, যা ঘটাতেন জানাতেন, আমরা রিপোর্ট করতাম। যেহেতু মানবজমিনে আমি তার পক্ষ নিয়ে কোনো রিপোর্ট করিনি, তাতে তিনি কিছু মন খারাপ করেছিলেন।

এরই মধ্যে একদিন রাতে আমরা সাংবাদিক সমিতির দোতলায় আরাম করে টিভি দেখছিলাম, হুট করে খবর এলো প্রফেসর আজাদ  চৌধুরী স্যারের ওপর গুলি হয়েছে। কমার্স ফ্যাকাল্টিতে এই ঘটনা ঘটেছে। আমরা ছুটলাম । আজাদ স্যার এ জন্য সরকার দলীয়দের অভিযুক্ত করলেন। কিন্তু ক্রস চেক করে দেখা গেলো স্যারের অভিযোগ ঠিক নয়। তবুও অফিসে খবরটি দেয়া হলো- যেহেতু আজাদ চৌধুরী স্যার বিদায়ী সরকারের আমলের শেষ ভিসি ছিলেন, তা গুরত্ব সহকারে ছাপাও হলো।

ফলোআপ রিপোর্ট করতে গিয়ে জানতে পারলাম, সেই শিক্ষকই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। বিস্মিত হলাম এবং নিজের দিকে আরেকবার তাকালাম, এ কোথায় বসত করছি। আজাদ স্যারও সম্ভবত সেটি পরে জানতে পরেছিলেন, তাই এ নিয়ে নীল দলের আন্দোলন আর হয়নি।

এ রকম আরো উন্নত রুচির পরিচয় অনেক শিক্ষক দিয়ে থাকেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র।  আমরা এটাও দেখি  কোনো কোনো শিক্ষক  সরকারের আমল বুঝে মন্তব্য করেন।

 তবে বরাবরই আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়েছে, তাহলো যারা শিক্ষকতা করবেন, পান্ডিত্য অর্জন করে তা বিতরণ করবেন বলে জীবনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের ঘর সংসার করা উচিৎ নয়। কারণ বৈষয়কি বিষয় আর জ্ঞানের চর্চা দুটোর এক সাথে চালানো খুবই কঠিন।

যদিও এটা একটি অস্বাভাবিক প্রস্তাব।

তবে দ্বিতীয় প্রস্তাব শিক্ষকদের যথেষ্ট বেতন ও  সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।  নইলে রাজণীতি, দলবাজি আর ফাও আড্ডায় সবাই মগ্ন থাকবেন। নিশ্চিত ভাবেই এটা হবে।  


 

     

কিস্তি :: ৮৬:: যৌবনা ঝরণা, আনন্দময় পাহাড় সমুদ্র ভ্রমণ

আমারা সংখ্যায় ১৯ জন। ছুটলাম পাহাড় ও সমুদ্র দেখার জন্য। সালটা ২০০৬।  ট্যুরিস্ট সোসাইটি থেকে আমার মেয়াদের শেষ দিকে ঘটনা। বরষাকাল। টুই টম্বুর  কাপ্তাই লেক।

রাতে কমলাপুর থেকে বাসে চড়লাম-বাস চলছে। আমরা আড্ডায় মগ্ন। এমন আড্ডা যে, অন্যরা একটু বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেন। সে দিকে  চোখ রাখার ফুরসত নাই। মধ্যরাতে দেখলাম-ঘুম, প্রচণ্ড ঘুমে ক্লান্ত সবাই।

রাঙ্গামাটির রাস্তায় ঢুকতেই বাসের ঘূর্ণিচক্র। চোখ কচলে সকাল দেখলো সবাই। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ জমে আছে। দূরে সূর্য উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে।

বাটফুলের পাতা ছুঁয়ে পড়ছে, অল্প আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টি। আমাদের এমন ট্যুরের জন্য জনপ্রতি ফি ছিল ১৯০০ টাকা। হোটেলে ছিলাম ৪ রাত। ঘুরেছি  ৫দিন। সেই ট্যুর এতটা আনন্দঘন ছিল, সেটি এখনো আপ্লুত করে।

রাঙ্গামাটি শহর হয়ে রিজার্ভ বাজারে সিনেমা হলের সামনে নামলাম আমরা। সামনে তাকালে গ্রিণ ক্যাসল। চন্দন দা বলে গেছেন,' তারকে ভাই আসবেন।' তাই হোটেলের অন্য সহকারি ম্যানেজার ফরহাদ চাবি নিয়ে বসে আছেন।

 রুম বুঝে পাওয়ার পর  দেখলাম মেঘলা আকাশ বৃষ্টি ঝরিয়ে গেলো। টিপু ভাইয়ের গ্রিণ রেস্টুরেন্টের কাঠের নিচতলায় আমরা পরোটা, ডিম আর চা খেতে খেতে ভাবছিলাম,  লেকে নৌকায় আজকে ঘোরা ঠিক হবে কিনা।

তবে ভাবনার আগেই কামাল হাজির, বলল- 'তারেক ভাই, কখন  আসলেন?' নৌকা আনতে গেলাম বলে বের হয়ে গেলো। আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর অপেক্ষা করলো না।

কালো ছাদ অলা একটা নৌকা নিয়ে মসজিদ ঘাটে আসলো কামাল। বলল- 'এইটা বড়ো নৌকা আছে; নিয়ে আসলাম। আপনি অনেক দিন পরে এসেছেন ,তাই।'

আমরা হোটেল ফেরার দরকার মনে করিনি, উঠে পড়লাম নৌকায়। কামাল নৌকা চালাচ্ছে। সেইবার ট্যুরে ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করেছি সবাই।

এর কারণ আমরা সবাই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। দু'একজন অতিথিও ছিলো। তারাও আনন্দে কাটিয়েছেন পুরো সময়।

রাজার বাড়ি ও বৌদ্ধ বিহার হয়ে আমরা ছুটছি শুভলং। এরই মধ্যে বৃষ্টি। সবাই ভিজছি। আনন্দময় বৃষ্টিতে ভেজা কতটা উপভোগ্য সেটি সবাই জানলো আরো একবার!

সাদিয়ার অ্যাজমার সমস্যা! তাতে কি?  সবাই-বৃষ্টিতে ভিজছে, আর ও নৌকার ছাদের নীচে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না।
সবাই নৌকার ছাদে বসে আছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে  পুরো পাহাড়, বড় বড় ফোঁটায় কাপ্তাই লেকের ওপর গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি।

বরকল মোড়টা পার হতেই একটা বড় ঝরণা চোখে পড়লো- শীতের সময়  এটা থাকে না। এতজল, এত প্রাণ, এত প্রাচুর্য নিয়ে দুরন্ত একটা ঝরণা ছুটছে, সেখানে আমরা নামবো না, হতে পারে না।

 হই হই করে আমরা নেমে পড়লাম, কামাল বলল, এখানে সিকিওরিটি সমস্যা থাকতে পারে। আমলে নেয়ার মত সময় ছিল না। প্রায় এক ঘন্টা  বহমান ঝরণার জলে আমরা ডুবে থাকলাম। তার পর উঠতে উঠতে আরো ১৫ মিনিট।

শুভলং ঝরণাতে বর্ষায় যে পানি থাকে, ভাবনার বাইরে ছিল। সে ঝরণায় আরো দু'ঘন্টা কাটানোর পর আমাদের কারো কারো হাঁচির উপক্রম হলাে- তাহলে কী করা যায়, ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার উপায় কি? এ সব ভাবনার মধ্যে আমরা। ততক্ষণে কামাল নৌকা ভিড়ালো  সেনা ছাউনির কাছে।

নৌকা থেকে নেমে সেনা ছাউনির সামনের রাস্তা ধরে শুভলং বাজারে আমরা।  সৌদিয়া রেস্টুরেন্টের দরজায় আসার আগেই বুদরুজ ভাই এগিয়ে আসলেন। বললেন, আরে 'তারক' ভাই! আপনি আসবেন, আমাদের এটা 'খল' দিবেন না। করছেন কি, সবাই ভিজে আছেন, জ্বর আসবে।

 বুদরুজ ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলছি, ফাঁকে সৌদিয়া রেস্টুরেন্টের  নীচতলায় চুলার পারে সবাই। শরীরটা শুকিয়ে নিলাম । এর মধ্যে বুদরুজ ভাই লেকের কালিবাউশ মৎস, পাহাড়ি সবজি  আর  মশুর ডাল নিয়ে  খাবার রিডি করলেন।

খাওয়ার পর মিষ্টির ব্যবস্থাও করলেন বুদরুজ ভাই। লোকটাকে আমি খুঁজে বের করেছিলাম ২০০৪ সালে। সে সময় ছোট্ট একটা ঘর ছিল। লম্বা সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর বুদরুজ ভাইয়ের দোকান। সেবার আমরা সেখানে  গুরুর গোশত দিয়ে একবেলা খাওয়ার সুযোগ নিয়েছিলাম।

সন্ধ্যার  দিকে শহরে ফিরলাম। ক্লান্ত সবাই । তারপরেও রাতে একবার গিরিশোভায় যাওয়া চাই। ভাসমান এ রেস্তোঁরা চালায় সীমান্ত রক্ষীরা।   নুডুলস, সফট ড্রিংকস দিয়েই ডিনার।

রাতের জার্ণি, সারা দিনের বৃষ্টি বিলাস মিলে ক্লান্তি ভর করেছে। ডুলুডুলু চোখ সবার।  হোটেল ফেরা। চন্দন দা বসে আছেন এককাপ চা খাবেন, বলে। নিরাশ করতে পারলাম না। তার আতিথেয়তা গ্রহণ করে রুমে ঢুকলাম।

পরের দিন আমরা যাবো বান্দরবান, সে জন্য আগেই লাইনের বাসের টিকিট কেটে আনলাম।
সকাল ৭ টার দিকে আমরা সবাই বাসে উঠলাম, ১৯ জন একসাথে হবার কারণে ফিশারি ঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস এসে আমাদের হোটেলের সামনে  থেকে পিক করলো।

বাস চলছে, লোকজন বাড়ছে।  এক সময় লোকারণ্য পুরো বাস। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। কেউ কেউ ছাদেও উঠেছেন।
এর মধ্যে একটা ঠালু রাস্তায় আমরা উপরের দিকে উঠবো, বাস একবার উপরে ওঠার চেষ্টা করে আবার নিচে নেমে এলো। আমরা খুব মজা পেলাম। এখন হলে নিশ্চিত ভয়ে মুখটা শুকিয়ে যেতো!

দ্বিতীয় দফা চেষ্টা করে বাস উপরে উঠতে সক্ষম হলো। এর আগে অবশ্য বাঙ্গালহালিয়া বাজারে সকালের নাশতা করেছিলাম আমরা। বাটারে ভাজা চিনি মাখানো পরোটা দিয়ে  সেই নাশতাটা স্মরণীয়।

কিছু কলা ও আম কেনা হলো বাঙ্গালহালিয়া বাজার থেকে, যে গুলো খেতে খেতে আমরা দুপুর নাগাদ বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড। এবার বাস আমাদের হোটেলে নামাতে চাইলো না। বলল, ট্রাফিক আটকাবে!

চান্দের গাড়ি ভাড়া করে হোটেলে ফিরলাম। এসহাক ভাই রুম রেডি করে দুলালকে বলে রেখেছেন, আমাদের জন্য চা এনে রাখতে, সে চা জুড়িয়ে যাচ্ছে বলে দুলাল ফোনে জানালো।

হোটেল পূরবীতে রুম বুঝে পাওয়ার পর দুপুরের খাবার হলো বাজারেই। বিকালটা কাটাতে গেলাম ধাতুজাতি মন্দির। এটাকে স্বর্ণ মন্দির বা  গোল্ডেন টেম্পল নামেও ডাকা হয়। সেখানে ছবি তোলা, মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো, দেবতার প্রাসাদ  দেখা, মিউজিয়াম ঘুরে  দেবতার পুকুরের জল ছুয়ে আসলাম আমরা। ঘণ্টাখানেক পরে গেলাম মেঘলাতে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে হোটেলে ফেরা।  
ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমরা ছুটলাম সেনা কাফেতে। ক্যান্টমেন্টের সামনের এ রেস্তোরা বিত্তবান পাহাড়ি মানুষের সান্ধ্যকালীন ভোজন ও সময় কাটানোর একটা ভালো জায়গা।

সেখানে বসনিয়ান রুটি, জালি কাবাব আর স্পঞ্জের মিষ্টি দিয়ে ডিনার হলো। স্পঞ্জের মিষ্টি তারা দুর্দান্ত বানায়। রাত সাড়ে ৮ টা। উঠে দাঁড়ালাম সবাই। সাঙ্গু নদীর ওপর কাঁপতে থাকা সেতুর ওপর অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। নির্মল বাতাসে বুক ভরে যাচ্ছিলো। সাথে রাতের বান্দরবান আর সাঙ্গুর ঢেউয়ের শব্দে  মোহিত হচ্ছিলাম সবাই।

সকালে পলাশকে বলা ছিল, চান্দের গাড়ি নিয়া আসতে। গন্তব্য আমাদের  চিম্বুক। পলাশ সকাল ন'টার মধ্যেই হাজির। বৃষ্টি  হচ্ছে। নাশতা সেরে বের হতেই দেখলাম  বৃষ্টির আবহটা বাড়ছে। সেটি মানার মত মন ছিল না।  আমরা বের হলাম।

১৯ জনের মধ্যে প্রায় সবাই  চান্দের গাড়ির ছাদে। সারা রাস্তায় অনেক মজা হলো। অবশ্য পুলিশের চেকপোস্ট  ও আর্মি পয়েন্টে ছাদ থেকে নেমে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে।  ভেতরে গুটি সুটি মেরে বসতে হয়েছিল বার কয়েক।

চান্দের গাড়ির সরাসরি চিম্বুকে। আমরা মেঘের ভেতর। অন্যরকম এক সকাল। মেঘের ভেতরে নিজেদের দেখছি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। কুয়াশার মত বৃষ্টির পানি।  ঘাসফুলের ডগায় জমে আছে শিশির বিন্দুর মত। তারপর আমরা নেমে আসি। নীচের ছোট্ট একটা দোকানে চা পানের বিরতি। সেখান থেকে গেলাম পাশের পাহাড়ে।  দুপুরে খিঁচুড়ি খেয়ে ফিরছি।

ছাদে থাকা মিটির চোখে গাছের পাতার বাড়ি লাগলো। তবুও ওর নামার নাম নেই। অন্যরা আবারো উঠে এলো। ফেরার পথে আমরা নামলাম  শৈলপ্রপাত ঝরণায়। বিশ ফুট চওড়া হয়ে পানি নেমে যাচ্ছে নিচে। এত যৌবনা ঝরণাটা আমরা শীতকালে দেখি ক্ষীণকায়।

ফারুকপাড়ার এ ঝরণার নিচের ক্যানেলে পানি অনেক। সেখানে নামলাম সবাই। অনেক্ষণ ধরে হেঁটে আবার পাহাড়ের ওপর দিয়ে ফিরে এলাম।  মানিক দেওয়ানের ঘরে চা পান  হলো। সঙ্গে এনার্জি বিস্কুট। এশা দেওয়ানের দোকান থেকে শাল মাফলার ও বাঁশের তৈরি কিছু মগ কেনা হলো। তারপর পলাশের তাড়ায় ফিরতে শুরু।

মিলনছড়িতে কয়েক মিনিটের বিরতিতে এককাপ কফি পান শেষে আমরা ফের শহরে। রাতে কেনাকটার নাম করে বাজারে ছোটাছুটি করলাম কিছুক্ষণ।

রাতে ঘুম, সকালে পূরবী হোটেলের নিজস্ব বাসে আমরা ছুটলাম কক্সবাজার।  সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে আমরা কক্সবাজারে আসলাম। এত চমৎকার একটা পরিবেশ, মানুষ জন কম। ভালো লাগছিলো বিকালটা। বিচে অনেক সময় কাটানোর পর  ফিরে এলাম রাতে।

জিয়া গেস্ট ইনের ওসমান খাবারটা  হোটেলের রুমের সামনে ডায়নিং টেবিলেই ব্যবস্থা করেছিল।শুটকি ভর্তা, চান্দা মাছ আরো কি সব আনলো।

পর দিন সকাল বেলায় আমরা গেলাম বিচে। ভেজাভিজি হলো, বালি খেলাও। মামুন বালি দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করলো, বৃষ্টি সে সব মিশিয়ে দিলো। এভাবে দুপুর।

হোটেলে ফিরে বিকাল বেলায় আমরা চলে গেলাম ইনানী। ভেজার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তবুও ভেজা হলো। অনেক্ষণ। ডাব, কলা এবং বাঁশের সাঁকোয় পানি পারাপার নিয়ে  অনেকটা সময় কাটানোর পর ফিরে আসি হিমছড়ি। সেখানে সন্ধ্যা। পাহাড়ের চূড়ায় অনেক্ষণ আড্ডার পর বৃষ্টি ভেজা ট্যুরের সমাপ্তি।

সেই সাথে একটি আনন্দময় অভিজ্ঞতার সঞ্চয়!        

বিদায় সরদার স্যার ! প্রিয় পিতৃ শিক্ষক!


খবরটা এমনভাবে আসবে, জানা ছিল না। সরদার স্যার চলে যাবেন, এটাও ভাবনার বাইরে। স্যারের শরীর খারাপ, এটা জেনেছিলাম। কিন্তু এভাবে আচমকা স্যার চলে যাবেন, মেনে নিতে পারছি না।

আমার জানা মতে, জ্ঞান তাপস রাজ্জাক স্যারের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে শেষ নির্মোহ ব্যাক্তি ছিলেন সরদার ফজলুল করিম স্যার।
আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল ২০০২ ও ২০০৩ সালে। তার পর আরো কয়েকবার।  তাঁর সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল একবারই।

তার বইয়ের সাথে পরিচয় ১৯৯৯ সালে। ক্লাসে ঢুকেই জানতে পারলাম, স্যারের প্লেটোর রিপাবলিক অনুবাদ করেছেন, যেটি আমাদের পাঠের জন্য কেনা দরকার।

তবে মানুষ হিসাবে সরদার স্যারকে আবিষ্কার করি আরো কিছুদিন পরে, ২০০২ সালে। রাজ্জাক স্যার '৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর মারা যাবার পর তাকে নিয়ে আলোচনায় যে দু'জন মানুষকে আমি চিনতে পেরেছি; তার একজন সরদার স্যার। আরেকজন আহমদ ছফা।

আহমদ ছফার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। তবে সরদার স্যারের সাথে পরিচয় এবং আলাপ দু'টোই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু  নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথাও বলেছিলেন, সে সময়।

২০০২ সালে ডাকসু ভবনের সামনে একজন হালকা পাতলা মানুষ রিকশা থেকে নামলেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। ডাকসু সংগ্রহ শালার গোপাল দা এগিয়ে আসলেন।  স্যারের মুখটা দেখেই মনে করতে পারলাম বইয়ের পাতায় দেখা ছবিটার সাথে মিলে যাচ্ছে।

পরিচিত হলাম স্যারের সাথে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ছি শুনে খুশী হলেন। ডিপার্টমেন্টের খোঁজ খবর নিলেন। গোপাল দা আমার সে সময়কার সম্বাদিক পরিচয়টাও স্যারের কানে  দিলেন।

বিম্পি সরকারের সময় ছিল সেটি, রাজনীতি নিয়ে স্যারের সাথে অল্প কয়টা কথা হয়েছে। তিনি রাজনীতির চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়লের পুরনো দিনের গল্প করলেন। বললেন, এখন সব কিছু কেমন হয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির দিকে নজর দিতে হবে।

স্যার বললেন, তোমরা যেহেতু স্টুডেন্ট এবং জার্নালিস্ট। তোমাদের উচিৎ হবে  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যাতে নজর দেয় সে জন্য লেখালেখি করা। পড়ুয়াদের উৎসাহ দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা। সাধারণত যারা জ্ঞান চর্চা করে থাকেন, তারা প্রচার নিয়ে মাথা ঘামান না।তাই তাদের কাজের সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে!

স্যার বরিশালের উজিরপুর থেকে ঢাকায় আসার পর ঢাকার যে রূপ দেখেছেন, সেটিও জানালেন। বললেন, এই যে তোমরা যানজট দেখো, আবর্জনা দেখো। এটা কিন্তু আমাদের মনের ভেতরও আছে। আমরা যদি নৈতিকভাবে হতে না পারি; তাহলে কোনো কিছুই ভালোভাবে করতে পারবো না।

যত পড়বে, তত জানবে।  যে পেশাতেই থাকো, পড়বে।  রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে যেহেতু পড়ছো, রাজনীতির শুদ্ধতার জন্য  কাজ করো। আমরা এখন আর কিছু করতে পারবো না। তোমরা করবে।

এভাবে অনেক কথা। প্রায় ঘন্টাখানেক। গোপাল দা স্যারের কয়েকটা ছবি তুলে রাখলেন। গোপাল দা'র সংগ্রহে স্যারের অনেক ছবি আগে থেকে আছে। গোপাল দা সেই বার স্যারকে বলেছিলেন, স্যার আপনি আমার বাসায় চলে আসেন। আমি আপনার খেদমত করার সুযোগ চাই।

স্যার স্মিত হাসলেন। বললেন, গোপাল তোমার কাজ ভালো চলছে।

এরপরও স্যারের সাথে দু'তিনবার দেখা হয়েছে। আজিজ মার্কেটেও স্যারকে দেখেছি।

ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর এতগুলো বছর গেলো- কেবল স্যারের বই পড়ছি, কিন্তু স্যারের কাছে যাইনি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানের বাতিঘর নিভে গেছে।

স্যার  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি, অগ্রগতি, গবেষণা ও নতুন নতুন বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি কথা সব সময় বলতেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা থেকে অবসরের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা মজবুত করার জন্য স্যারের যে আকাঙ্খা দেখেছি, সেটি সমকালীন অন্য  শিক্ষকদের চোখে দেখিনি(অল্প কয়েকজন ব্যাতিক্রম আছেন। যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম স্যার)।

মূলত দর্শনেই স্যারের পড়াশোনা। কিন্তু রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে তিনি এসেছিলেন রাজ্জাক স্যারের অনুরোধে। রাজ্জাক স্যার দিল্লির ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ব্দ্যিালয়ের আড়াইশ টাকার মাইনের চাকরি নিয়ে এসছিলেন, এ বঙ্গদেশে একটি অনন্য বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্নে। সেই স্বপ্নের সারথী সরদার স্যাররা।

আজ তার বিদায় দিবসে  শ্রদ্ধা জানাই। স্যার পরপারে ভালো থাকেন। স্যার যেদিন বিদায় নিলেন, সে দিনটি আন্তর্জাতিক বাবা দিবস। বিদায় প্রিয় পিতৃ শিক্ষক। বিদায়।