কাসেমে আটকে যাওয়া সাহিত্যের রুচি অরুচি!



কাসেম বিন আবু বাকার, ছবি- এএফপি, সংগ্রহ সূত্র: ডেইলি মেইল 



প্রত্যেক লেখক তার এবং তার আশ-পাশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা করেন। সে ব্যাখ্যা ভুল হইতে পারে। সে  ব্যাখ্যা আমি নাও নিতে পারি । কিন্তু জান্তে কোন অসুবিধা নাই। কাসেম বি আবু বাকারের লেখা বঙ্কিম , রবীন্দ্র-নজরুল- শরতের নিক্তিতে মাইপা পাঠ করনে আমি বিশ্বাসী না। আমার হাতে  সময় আছে, আমি পড়ি। যা পাই পড়ি। ছাইপাশ যা পাই তাই!

আমাদের কৈশোরে একটা বই পড়তে সময় নিতাম ১ থেকে দেড় দিন, তাইলে কী পরিমাণ বই দরকার!  চিন্তা করেন! সেই বই কি সুশীল রুচিকর  পাঁচক লেখকেরা লেইখা আমগো সামনে আন্তে পারছিলেন! এবং প্রকাশকরা!  

হুমায়ূন পইড়া হলুদ রঙ ভালো লাইগতো।  জুতা ছাড়া রাস্তায় হাঁটতাম, জোছনা খাইতাম, কুত্তার লগে কতা কইতাম!  ভাল্লাগতো।  যুক্তি মানতাম না। এটা  ভালো কি খারাপ সেইটা তর্কের ব্যাপার। কিন্তু পাঠক হিসাবে আমি ত এটা নিছি। আপনি আমার নেয়াকে  আপনার নিক্তিতে মাইপা রুচিকর অরুচিকর নির্ধারণ ক্যামনে। 

সাহিত্য  লইয়া কত রকমের কতা। বাজাইরা সাহিত্য কইয়া হুমায়ূনরে তো  ব্যাপক সমালোচনা কইরছিল  আহমদ ছফা। কিন্তু  ছফার চিন্তা আপনার মইধ্যে সংক্রমিত অইতে পারে। তার সাহিত্য  সে অর্থে কাউরে সংক্রমণ কইরছে, এ রকম চোখে পড়নের মত ঘটনা কোথাও পড়ি নাই।  

এ দেশের  যারা সাহিত্য কইরে খান, যারা সংস্কৃতির ব্যবসা করেন, তারা নিজের বাইরের লোকের সব কাজকে খাটো কইরা দেখেন।  যারা তাগো উৎসাহিত কইরে থাকে, তাগো ব্যাপক সমালোচনা কইরা থাকেন। 


হালের সমালোচনার  টার্গেট এক  কাসেম বিন আবু বাকার।  তার বই আমি নিজেও পড়েছি।  শব্দ-বাক্য গাঁথুনি ভাল্লাগবে না, আমার কিম্বা আপনার।  আবার অনেকের কাছে ওইটাই অমৃত সমান! যার যার টা তারে নিতে দ্যান! 

তার বই গল্প-উপন্যাস। ধর্মগ্রন্থ না।  তার বই তো বাংলা একাডেমির পুরস্কারের জন্য এপ্লাই করে নাই। আপনাদের কম্পিটিটর তো তিনি নন। তার মত করে তিনি  লিখেছে,  একটা বড় পাঠক শ্রেণি ধরেছে। এইটা আপনারে চুলকায় ক্যান।  

আফনে নিজের দিকে তাকান না কেন? একটা বই বাইর কইরা কত রকমের প্রচারণা চালায়া ত ৫০০ কপি সারা বছরে সেল কইরতে পারেন না।  সেইখানে কাসেমের বই হাজার হাজার বই  বেচা কেনা অয়। ক্যামনে কি! আপনের রুচি বিবেচনায় আইনলে তো সব পাঠকই অরুচিশীল! 

কাসেম বিন আবু বাকারের বই কিম্বা  আবদুল সালাম মিতুলের বইয়ের পাঠককে আপনি অবহেলার চোখে দেইখতে পারেন না। তারা তো আফনের উপ্রে চাইপা বসেন নাই। আফনের ভালোলাগে না, আফনে তারে ইগনোর করেন, হুদাই ত্যানা প্যাঁচাইয়া নিজের 'অক্ষমতা' ঢাকন যাইবো? জনাব-জনাবা! 

মানুষ ! লাশ এবং রানা প্লাজা !


ছবি: সংগ্রহ


বছর চারেক আগের এ রকম একটা দুপুর, শত শত মানুষ রাস্তায়। অটোরিক্সাটা ছুটছে। মানুষের ভিড় ঠেলে রানা প্লাজার কাছে পৌঁছালাম। আশ পাশে উৎসুক মানুষ। পাশেই দেখলাম বিরিয়ানির প্যাকেটের গন্ধ। কিছু লোক ভেতরে যাচ্ছে আসছে। পাশের ভবনে গেলাম, দেখলাম আমাদের সাহসী ফায়ার বিগ্রেডরের লোকজন, কাজ করছেন। নিজের স্বজন উদ্ধারের মতই প্রণান্ত চেষ্টা তাঁদের। ধ্বসে পড়া ভবনের ভেতরে কিছু স্বেচ্ছাসেবি, মানব-শরীরের পঁচে যাওয়া মাংসের গন্ধ।

বাইরে- লাশ গুনছেন অনেকে। ঘটনার তিন দিন পর (২৭ এপ্রিল ২০১৩ )। দেখতে গিয়েছিলাম রানা প্লাজা ট্রাজেডি। লেখাটাও উদ্দেশ্য ছিল। বাইরে এসে রোড ডিভাইডারের ওপর দাঁড়ালাম। একজন নারী এগিয়ে এলেন আমার দিকে। নাম লাইজু। বললেন, তার বোন সীমার সাথে কথা হয়েছে, টয়লেটে আটকা। কিছু করা যায় কিনা? চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।

বোন সীমাকে জীবিত দেখতে মন কাঁদছে লাইজুর। বললেন, সীমা তিনতলায় কাজ করতেন। এক ছেলের মা সীমা ২৪ এপ্রিল সকালে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে কাজে এসেছিলেন। তারপর নিখোঁজ। চার্জ নেই মোবাইল ফোনে। তবুও বোনের মন মানে না। রিচার্জ করে কিছু টাকা পাঠালেন, বোনের ফোনে। কিছুক্ষণ পরপর বোনের মোবাইলে চেষ্টা করছিলেন। যদি কথা বলা যায়। যদি জানা যায় বোনটি কেমন আছে! শেষ পর্যন্ত তার আর কিছু জানা গেলো না।

একই রকম অবস্থা ছিল মাসুদ রানার। বগুড়ার সোনাতলা থেকে এসেছিলেন তিনি। বোন শাহিনূর ও ভাইয়ের মেয়ে নাজমার কোনো খবর জোগাড় করতে পারেননি। ছুটেছেন অধরচন্দ্র স্কুল, এনাম মেডিক্যাল, সিএমএইচ থেকে রানা প্লাজা।

তিন ছেলে ও একমাত্র কন্যার বাবা আবুল কাসেম ভূঁইয়া নিখোঁজ হয়েছিলেন । তার লাশের খোঁজে বড় ভাই মোহাম্মদ ইবরাহীম অধরচন্দ্র স্কুলে অপেক্ষা করেছেন। ছেলে শাফায়েত রানা প্লাজার সামনে ছিলেন। স্ত্রী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, যদি প্রিয় স্বামীর দেখা মিলে। না সে সব আশা মিথ্যে। দেখা মেলেনি স্বজনের ।

কিছুক্ষণ পর পর লাশ নিয়ে আসা হচ্ছে, সে লাশের গাড়ি যাচ্ছে অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। যে সব মানুষের জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছিল তাদের নেয়া হচ্ছিলো এনাম মেডিকেল ও সিএমএইচএ!

আমার জীবনের এ রকম করুণদৃশ্য এর আগে দেখিছিলাম সিডর আক্রান্ত শরণখোলায়। সেখানে মানুষের লাশ ঝুলে ছিল গাছে, ধান ক্ষেতে ভেসে ছিল মানুষের ফুলে ওঠা লাশ। সে এক হৃদয় বিদারক, নির্মম ও নৃশংস দৃশ্য! 

এটি দ্বিতীয় কঠিন এবং রূঢ় একটা কষ্টময় স্মৃতি হয়ে গেঁথে গেলো।

অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে এক নারী চিৎকার করে শুয়ে পড়ছিলেন। তার কাছে পৌছানোর আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। স্বামী সন্ধানী নারী। নিখোঁজের তালিকায় স্বামীর নাম লেখাতে এসেছিলেন।

ছোটবেলায় আমরা দেখতাম দুর্যোগের পর রিলিফ আনতে কিম্বা ইউনিয়ন পরিষদের দুস্থ সহায়তা পেতে লম্বা লাইন। জীবনে আমি প্রথম এবং একবারই লক্ষ্য করলাম, লাশ খুঁজতে লম্বা লাইন। এক নির্মম অভিজ্ঞতা আর করুণ আর্তির কোনো বর্ণনা করার মত ভাষা আমার জানা নেই।

সাভারের অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠজুড়েই হাহাকার। লাশের সংখ্যা নিয়েও ছিল ধুম্র জাল। নিখোঁজ মানুষের পরিসংখ্যানও সঠিকভাবে মিলেনি।

ইতিহাসের এ ভয়াবহতম ঘটনায় দু'হাজারের বেশি মানুষ মরে বেঁচে গেছে! যারা আহত হয়ে বেঁচে গেছেন, তাদের জীবন চলছে দুর্বিসহ অবস্থায়।

এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েনি। রসিকতা হয়েছে। নিপীড়ত মানুষের পক্ষে আমরা কাউকে দাঁড়াতে দেখিনি। সবার শরীরে এখন চিকনাই জমেছে। চোয়ালে জমেছে লাস্যতা। কেউ রোদে পুড়ে আন্দোলন করে অধিকার আদায়ের লড়াই করতে চান না! 'দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই করা' লোকেরা তো এখন সরকারের চাকা ঘোরাচ্ছে! সুতরাং মরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য দিন উল্লেখ করেই শোকই একমাত্র প্রাপ্য! তাও এর দু এক বছর তাও থাকবে বলে মনে হয় না।

শ্রমজীবি মানুষের রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না।