ড. ইউনূসকে ঘিরে নোংরা-চর্চা!

'ড. ইউনূস একটা চোর', এটা শুনতে পারলে এ দেশের এক শ্রেণীর সম্বাদিক নামের প্রাণী প্রচণ্ড আনন্দ উত্তেজনা অনুভব করেন।  যেটি হয়ত তারা বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের হারেও অনুভব করেন না।  ইউনূসকে ঘিরে দেশীয় গণমাধ্যমের অরুচিকর নোংরামি থেকে এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি । 

দেশের বহু চুরি, ডাকাতি ও লুটের খবর এদের মন খারাপ হয়, লুকুচুরি খেলে, এটাকে হালাল করার তরিকা আবিষ্কার করে এ সব নিম্ন রুচির লোকেরা। সম্বাদিকতা জগতকে এরা কুলষিত করেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েব ভিত্তিক পত্রিকা “দি ডেইলী কলার” গত ১৭ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন  প্রকাশ  করার পর বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম এতে এতটাই উত্তেজেতি বোধ করে, এ বিষয়ে অভিযুক্তের বক্তব্য জানার ফুসরত পর্যন্ত  পায়নি। একমাত্র ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট দেখলাম তারা ঘটনা সম্পর্কে ইউনূস সেন্টারের কাছে জানতে চেয়েছে, বাকিদের জানার দরকার নেই। উঠতে বসতে আমেরিকাকে গালি দেওয়া কিছু লোকও  ভুল রিপোর্টটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছেপে দিয়েছে। আহা, কি দারুণ নৈতিক  সম্বাদিকতা। 

আর ইউনূস বেচারাও বিষয়টা আমলে নিলনে না প্রথমে, পরে অবশ্য একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে, দেমাগি-দলদাসত্বের সম্বাদিকতার জগতে জ্ঞানীর কদর থাকবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। 

“Disgraced Clinton Donor Got $ 13 Million in State Department Grants Under Hillary” শিরোনামের রিপোর্টে বলা হচ্ছিলো- প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন সরকারের অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর ক্ষমতাশালী বন্ধু সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁকে এই অর্থ পেতে সাহায্য করেছেন। প্রতিবেদনটিতে আরেকটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলা হয়েছে যে, প্রফেসর ইউনূস মিসেস ক্লিনটনের পারিবারিক ফাউন্ডেশনকে অনুদান দিয়েছেন। এতে এমন একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে মিসেস ক্লিনটনের পারিবারিক ফাউন্ডেশনকে অনুদান দিয়েছেন বলেই প্রফেসর ইউনূস মার্কিন সরকারের নিকট থেকে অনুদান পেয়েছেন।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে দুর্নীতির অভিযোগে প্রফেসর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছিল। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার। 

ইউনূস সেন্টার এ রিপোর্টের ব্যাখ্যায় বলছেন, ' প্রথমত, প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন সরকারের কোন টাকা গ্রহণ করেননি। উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য সৃষ্ট এজেন্সীগুলো কোন ব্যক্তিকে অর্থ দিতে পারেই না। রিপোর্টটিতে সম্পূর্ণ একটি মিথ্যা প্রচারিত হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রফেসর ইউনূসকে ১৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হয়েছে। একজন ব্যক্তিকে টাকা দেয়ার কোন ক্ষমতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেই। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারককারী সংস্থা এটা হতে দেখলেই এ ব্যপারে বড় রকম একটা প্রতিবাদ জানাতো। প্রতিবেদনটি মার্কিন সরকারের সংস্থাগুলির কাজ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করেছে।'

'দ্বিতীয়ত, পত্রিকাটি বলছে যে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে পাওয়া তথ্য থেকে তারা জানতে পেরেছে যে প্রফেসর ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে একবার ১ লক্ষ ডলার, আরেকবার ৩ লক্ষ ডলার অনুদান দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে এরকম কোন তথ্যই নেই। অনুদান বা অন্য কোন খাতে প্রফেসর ইউনূসের কোন নামই ওয়েব সাইটে নেই। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে যোগদান করার জন্য ফি বাবদ টাকা দিয়েছেন এটার উল্লেখ আছে। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এখানে যোগ দিতে হলে ফি দিয়ে যোগদান করতে হয়। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফি দিয়ে তাই করেছেন।'

https://www.clintonfoundation.org/contributors?category=$100,001 to $250,000&page=2

এই ওয়েব সাইটে কোথাও কোনো তালিকায় দাতা হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের কোনো নাম নেই। অথচ প্রতিবেদনে এই মিথ্যাটাই সাজিয়ে প্রচারিত হয়েছে। এমনকি শিরোনামেও সজোরে তাই প্রচার করা হয়েছে। 

তৃতীয়ত, পত্রিকাটি তার প্রতিবেদনের শিরোনামে উরংমৎধপবফ বা “অপমানিত” শব্দটির পরিবর্তে “বিপুলভাবে সম্মানিত” কথাটি ব্যবহার করলে তা যথার্থ হতো কারণ প্রফেসর ইউনূসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০১০ সালে “কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল” প্রদান করে যা প্রতিনিধি পরিষদে উভয় দলের প্রতিনিধিদের বিপুল ভোটে ও সিনেটে উভয় দলের সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করা হয়। এছাড়াও প্রফেসর ইউনূস ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নিকট থেকে “প্রেসিডেনসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” গ্রহণ করেন। তাঁকে “বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার” (১৯৯৪), “কেয়ার হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড” (১৯৯৩) সহ অসংখ্য পুরষ্কার এবং মার্কিন সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে গত তিন দশক ধরে অসংখ্য সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

ইউএসএআইডি-র ১৩ মিলিয়ন ডলার কোথায় গিয়েছে? গত অনেক বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে “গ্রামীণ” ও “ইউনূস” নাম ধারণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস এবং গ্রামীণ নামের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে এই সকল প্রতিষ্ঠান এই নাম গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সেসব দেশে দরিদ্রদের সেবা প্রদান করতে ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে সৃষ্টি করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম দু’টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ও গ্রামীণ আমেরিকা। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর ২০টি দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচিকে অর্থ সহায়তা দিতে এই প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক দাতাদের মধ্যে ইউএসএআইডি গত দশ বছরে একটি ক্ষুদ্র দাতা মাত্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনী ও নিবেদিতপ্রাণ রিপাবলিকান তাঁর নিজ অর্থে ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্কে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে গ্রামীণ আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত সফল হওয়াতে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এখন আমেরিকার ১১টি শহরে গ্রামীণ আমেরিকার কর্মসূচি চালু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যতই সম্প্রসারিত হয়েছে, ততই আরো বেশী টাকার প্রয়োজন হতে থাকে। প্রতিষ্ঠাতা নিজের অর্থে এটা বড় করা যাচ্ছিল না বলে তিনি বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহে লেগে যান। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর সময় ও শ্রম দিতে থাকেন। এতেও তিনি সফল হন। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ৬৫,০০০ মহিলা ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে এ পর্যন্ত ৩৮০ মিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে যার আদায় হার ৯৯% এর বেশী। গ্রামীণ আমেরিকার কর্মসূচিতে ইউএসএআইডি-র সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত সামান্য। ইউএসএআইডি-র তহবিল পেয়েছে এরকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা” যা ২০১২ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের দু’জন তরুণ মহিলা পেশাজীবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত। “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা” ব্রাজিল, কলম্বিয়া, হাইতি, আলবেনিয়া, বসনিয়া, মেসিডোনিয়া, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও ভারতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি এই দেশগুলোতে ৮.৬ মিলিয়ন ডলারের বেশী মূলধন বিনিয়োগ করে ৩৪টি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে সামাজিক ব্যবসা তহবিল প্রতিষ্ঠা করেছে। 

প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনেক ডোনার, ব্যাংক, বিত্তশালী ব্যক্তি ও বিনিয়োগকারী অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। ইউএসএআইডি এই বহুসংখ্যক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মাত্র একটি। ইউএসএআইডি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কাজের গুণগত মানের জন্য অর্থ সহায়তা দিয়েছে, কোন উচ্চ পদে আসীন কারো বন্ধুকে খুশী করতে নয়।

এই প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য যদি সৎ হতো তাহলে তথ্য অনুসন্ধানের সামান্যতম চেষ্টা করলেই তারা তা জানতে পারতো, সত্যের সন্ধান পাওয়া যেতো। সমস্ত প্রতিবেদনটি জুড়ে যত সব মিথ্যা পরিবেশন করা হয়েছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা সাংবাদিকতার প্রতি লক্ষ্য না-রেখে শুধু মিথ্যা প্রচারণায় ব্যস্ত থেকেছে।

দেশের সীমান্ত নিয়ে কটাক্ষ করার সিনেমা 'শঙ্খচিল' অগ্রহণযোগ্য

কি করলে, কি হতো, বা কারা উপকৃত হতো, কারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ সব আলোচনার চে বাস্তব অবস্থাটাই মুখ্য। আমরা স্বাধীন দেশ। সুতরাং এখানে আমাদের জোড়া লাগা থাকলে ভালো কি মন্দ হতো সেটি আমরা কল্পনা করতে পারি । তবে কিছু বাস্তবতা তো উপেক্ষা করা যায় না। 

বাঙালি পরিচয়ের জন্য যাদের আকুতি তারাই তো দাঙ্গায় শত শত মুসলিম ও হিন্দুদের বসতি পুড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা এসেছেন পূর্ববঙ্গে। আর পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা চলে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। 

তবে সবাই নয়। বহু হিন্দু বাংলাদেশে এখনো আছেন। বহু মুসলমান পশ্চিমবঙ্গেও। এটা তো নিশ্চিত এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সূত্রেও আমরা দাঙ্গার ভয়াবহতার আঁচ করতে পারি। 

তাহলে স্বাধীনতা সাড়ে ৪ দশক পরে ভারত বাংলাদেশ প্রযোজনার সিনেমা 'শঙ্কচিল' কীভাবে প্রশ্ন তোলে, দেশ ভাগটা সঠিক ছিল না। এটা ভাবনার বিষয়।
'অখণ্ড ভারত' সিনেমাটির মূল স্রোত। আমরা অখণ্ড ভারতে থাকলে লাভবান হতাম কি, হতাম না, তা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে একটা সরল রেখায় সমাধান টেনে দেওয়া মুশকিল--- শঙ্খচিল-- সিনেমায়ও আমরা দেখি সাম্প্রদায়গত একটা নিচুতা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যমান। সেখানে পুর্ববঙ্গের মানুষ কতটা ভালো, সুখে থাকতেন তা কল্পনা করা কঠিন ।
শঙ্খচিলে রূপসা চরিত্র ইনডিয়া চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পর সেখানে তাদের হিন্দু পরিচয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কুসুম সিকদারের মাথায় তুলতে হয় সিঁদুর। কন্যা তাদের বাঁচে না। অনুপ্রবেশকারী হিসাবে তাদের ঠাঁই হয় জেলে। আইন অনুসারে তাই হয়, হতেই হয়ে।
প্রসেনজিৎ মূল চরিত্র রূপকার। আমরা সিনেমার গোড়াতেই দেখি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসা ইনডিয়ানদের নৌকা ঘুরিয়ে দেয় বর্ডার গার্ড । তারা অনুনয় করে বিয়ে-নেমতন্ন সেরেই চলে যাবে। কিন্তু বিজিবি তাতে সাঁয় দেয় না। এখানে ইনডিয়ান মুসলিমদের দেখানো হয়, ইনডিয়ান হিসাবে তারা কেবল বিয়ের নেতমন্ন সম্পন্ন করতে আসছেন।
বিপরীত চিত্র বাঙালদের ক্ষেত্রে। বাঙালরা ভারত ঢুকছে চোরাচালন নিয়ে, মই দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছে। এ সময় ভোরে বিএসএফ'র গুলিতে খুন হলো একটা তরুণ।
বাঁশে ঝুলিয়ে লাশ নিতে অভ্যস্ত বিএসএফকে আমরা দেখি স্ট্রেচারে করে লাশ নিচ্ছে! আমরা ধারণা করতে পারি এ ঘটনা 'ফালানীর' ছায়া চিত্র। কারণ ঘটনার পর বিএসএফ'র উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে ' কমপ্লেক্স বর্ডার'। তাই এখানে মানবিকতা ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন বেহুদা! আমিও তাই মনে করি।
কিন্তু তাই বলে সীমান্তে হত্যা জায়েজ!
হতে পারে। কারণ বিএসএফ বলছে!
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিএসএফ কর্মকর্তা চরিত্র রূপায়নকারী বলছেন, তারা তদন্ত করে বিএসএফ জওয়ানদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন। সিনেমার শেষাংশ পর্যন্ত সে গল্পের বিষয়ে কোনো আলাপ আমরা দেখিনি।
সীমান্ত নিয়ে তার মন্তব্যও তাচ্ছেল্যের! রেডক্লিপ কিম্বা জিন্নাহ নেহরুকে জিজ্ঞেস করতে বলেন তিনি, কেন এ রকম সীমান্ত হলো।
আমরা আবার এও দেখি, বাংলাদেশের পত্রদূত কাগজের সাংবাদিক বিজিবি'র সাথে সীমান্ত দেখতে যায়, সীমান্ত সমস্যা দেখায় বিজিবি, বলে দেখেন তাল গাছের গোড়া বাংলাদেশে, মাথা ইনডিয়ায়। পিলার দেখান এবং হাজারের ওপর পিলারও নেই বলে জানান, যে গুলো নদীতে থাকতে পারত।
এখানে কি বিজিবি চরিত্র রূপায়নকারী সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছেন, নৌ সীমান্ত কি পিলার দিয়ে করতে হয়। একই সাথে সীমান্ত গ্রাম নিয়েও এখানে বিজিবি চরিত্র রূপায়নকারীদের আমরা তাচ্ছিল্য করতে দেখি--- দেখুন সীমান্তের গ্রামে কে কোন দেশের সেটা বোঝাও মুশকিল।
হতে পারে। তবে এ মুশকিল সামাল দেয়ার জন্য সীমান্ত রক্ষী। তারা এখানে সফলভাবে সিনেমায় উপস্থিত হতে পারত, সেটি কেন হয়নি প্রশ্নটা থেকেই যায়।
এখানে পত্রদূত কাগজের সাংবাদিক চরিত্রেও দেখি,বলছেন,'আমার মনে নয় সীমান্ত ঠিক করার সময় রেডক্লিফ নেশাগ্রস্থ ছিলেন।' তারক দাঁত কেলিরে হাসি !
একটি দেশের সার্বভৌমত্ব , সীমান্ত স্পর্শকাতর বিষয়, অথচ এ সিনেমাটির ক্ষেত্রে এটাকে মামুলি সিনেমেটিক ফরমেটে বিবেচনায় করা হয়েছে। এটা দুঃখজনক।
যে দেশে চাকমা ভাষায় নির্মিত সিনেমা 'মর থেংগারি'র মুক্তিতে সেন্সর বোর্ড গড়ি মসি করে, সে দেশে শঙ্খচিল এত সহজে কীভাবে হলের পর্দায় আসে, সেটি বুঝতে পারিনা !
আমরা প্রসেনজিৎকে দেখি নদীর তীরে বসে --- অন্নদা শঙ্কর রায়ের সে ছড়া কাটতে---'তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে/খুকুর পরে রাগ করো/তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!' ভারত ভাগে মনোকষ্ট তার।
বাদলকে আমরা দেখি একটা পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে অনেকগুলো চিঠি খুঁজে বের করতে, যেখানে তার পিতার সূত্রে প্রাপ্ত চিঠিতে বলা হচ্ছে, মুসলিমরা কীভাবে হিন্দুদের নিপীড়ন করেছে, চিঠি পড়তে পড়তে আমরা মুসলিম বাদল চৌধুরীকে পুড়তে দেখি, কষ্ট পাই।
আমরা এও একমত হই, যারা ধর্মের নাম করে অন্য ধর্মের লোকদের আক্রমণ করে তাদের ধর্ম ঘৃণা। তাদের ধর্ম কখনোই ইসলাম হতে পারে না। হিন্দু হতে পরে না!
সিনেমায় আমরা এটা দেখতে পারলে ভালো হতো, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমরাও একই রকম নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিক সত্য। এটা এডিয়ে গৌতম ঘোষ কি বার্তা দিতে চাইলেন, সহজে অনুমেয়!
সিনামায় আমরা মামুনুর রশীদকে দেখি সাতক্ষীরার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে, তার নাম- তপন বাগচী। বাদল চৌধুরীর খুব কাছের একজন; তার স্কুলেইর শিক্ষক।
বাদল স্যারের মেয়ে রূপসার হার্টের রোগ ধরা পড়ার পর তপন বাগচীর পরামর্শেই তাকে নেয়া হয়, সাতক্ষীরা ওপারে টাকী হসপিটালে। তপন বাবুর আত্মীয় চরিত্র রূপায়নকারী মিস্টার বাগচীর ফোন পেয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তার আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মত।
আমরা দেখি বাদল স্যার তার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে ইনডিয়া গেলেন, টাকীর সেই ভদ্রলোক তাদের বললেন, সীমান্ত আইন কড়াকড়ি। মেয়ের চিকিৎসার জন্য তাদের হিন্দু পরিচয় দিতে হবে। হসপিটালে তাই দেয়া হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য রূপসাকে স্থানান্তর করা হয় কলকাতায়। সেখানে নিয়ত তাদের লুকিয়ে চলতে হয়। এখানে আমরা অবশ্য নামাজি বাদল চৌধুরীকে আবিষ্কার করি, যাকে আমরা দেশে বারবরই গান বাজনায় মগ্ন থাকতে দেখি, তিনি হঠাৎ সেখানে বিরাট মুসল্লী। তার স্ত্রীর সিঁথিতে সিঁদুর তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে,--- নিজের পরিচয় লুকানোর কষ্টের চিত্রায়ন। তবে একই সাথে তপন বাগচীর আত্মীয়'র তৈরি করে দেয়া অবৈধ নাগরিকত্ব সনদ দিয়ে কন্যার চিকিৎসার করানো দ্বিধাদ্বন্ধের সাথে লক্ষ্য করি। এখানে দ্বি-মুখিতা উপলব্ধি করবেন যে কেউ!
আমরা জানি সন্তানে জন্য মা বাবা যে কোনো কিছুই করতে পারেন, কারণ সন্তান সবারই প্রিয়! কিন্তু একের পর এক অপরাধ, ধর্ম, দেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য, জালিয়াতি--- সবই হয়ত মেনে নয়ো যায়, কিন্তু এর উদ্দেশ্য যখন চূড়ান্ত বিচারে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে ঘোষণা, তখন নিশ্চিতভাবে এখানে একটা ইল মোটিভ থাকতে পারে বলে, দর্শক হিসাবে সন্দেহ করার সুযোগ থাকে।
একটা লোক মুসলিম, যে তার কন্যাকে সত্য কথা বলতে শেখায়, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কন্যাকে হসপিটালে ভর্তি করায়। মারা যাবার পর সন্তানের লাশের ডিসচার্জ লেটার নিতে গিয়ে বাদল চৌধুরীর অনুতাপ প্রকাশ করে নিজেদের "অনুপ্রবেশকারী" ঘোষণা এক সাথে যায় না।
তারপর থানা পুলিশ। এর মাধ্যমে কি ভারতে বহু বাঙালকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দাবি জনতা পার্টির এজেন্ডার সফল চিত্রায়ন হলো!
লাশটা অবশ্য ফেরৎ পাঠানো হয় বাংলাদেশে। সে সাথে লাশ দাফনের পথে যাওয়ার সময় তপন বাগচীকে তার ইনডিয়া প্রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় রূপসার চাচা আনিস। এটাও বাংলাদেশের মানুষের হিন্দুদের প্রতি দুষ্টুমিচ্ছলে বলা কথা। এর সিনেমায় চিত্রায়ন নেতিবাচক ।
সাকুল্যে সিনেমার গল্পটা ঘুরপাক খায় সীমান্ত নিয়ে। সীমান্ত--- মানুষের জীবন বিপন্ন করে, স্বাধীন চলাফেরা আর বাঙালিত্বে অনেক বড় বাধা। এটাই সিনেমার ট্যাগ লাইন।
এ ধরণের সিনেমা আমাদের তিরিশ লাখ বা তারো বেশি শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা, দু'লক্ষ বা তততোধিক নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। সে ত্যাগের সহযোগিতা আমরা ইনডিয়ার কাছ থেকে পেয়েছি, সেটি স্বীকার করে নিয়েই বলছি--- এ ধরণের বার্তা, অখন্ড ভারতের আকাঙ্খা , সীমান্তকে কটাক্ষ করার সিনেমা শঙ্খচিল গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।