দেশের সীমান্ত নিয়ে কটাক্ষ করার সিনেমা 'শঙ্খচিল' অগ্রহণযোগ্য

কি করলে, কি হতো, বা কারা উপকৃত হতো, কারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ সব আলোচনার চে বাস্তব অবস্থাটাই মুখ্য। আমরা স্বাধীন দেশ। সুতরাং এখানে আমাদের জোড়া লাগা থাকলে ভালো কি মন্দ হতো সেটি আমরা কল্পনা করতে পারি । তবে কিছু বাস্তবতা তো উপেক্ষা করা যায় না। 

বাঙালি পরিচয়ের জন্য যাদের আকুতি তারাই তো দাঙ্গায় শত শত মুসলিম ও হিন্দুদের বসতি পুড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা এসেছেন পূর্ববঙ্গে। আর পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা চলে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। 

তবে সবাই নয়। বহু হিন্দু বাংলাদেশে এখনো আছেন। বহু মুসলমান পশ্চিমবঙ্গেও। এটা তো নিশ্চিত এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী সূত্রেও আমরা দাঙ্গার ভয়াবহতার আঁচ করতে পারি। 

তাহলে স্বাধীনতা সাড়ে ৪ দশক পরে ভারত বাংলাদেশ প্রযোজনার সিনেমা 'শঙ্কচিল' কীভাবে প্রশ্ন তোলে, দেশ ভাগটা সঠিক ছিল না। এটা ভাবনার বিষয়।
'অখণ্ড ভারত' সিনেমাটির মূল স্রোত। আমরা অখণ্ড ভারতে থাকলে লাভবান হতাম কি, হতাম না, তা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে একটা সরল রেখায় সমাধান টেনে দেওয়া মুশকিল--- শঙ্খচিল-- সিনেমায়ও আমরা দেখি সাম্প্রদায়গত একটা নিচুতা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যমান। সেখানে পুর্ববঙ্গের মানুষ কতটা ভালো, সুখে থাকতেন তা কল্পনা করা কঠিন ।
শঙ্খচিলে রূপসা চরিত্র ইনডিয়া চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পর সেখানে তাদের হিন্দু পরিচয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কুসুম সিকদারের মাথায় তুলতে হয় সিঁদুর। কন্যা তাদের বাঁচে না। অনুপ্রবেশকারী হিসাবে তাদের ঠাঁই হয় জেলে। আইন অনুসারে তাই হয়, হতেই হয়ে।
প্রসেনজিৎ মূল চরিত্র রূপকার। আমরা সিনেমার গোড়াতেই দেখি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসা ইনডিয়ানদের নৌকা ঘুরিয়ে দেয় বর্ডার গার্ড । তারা অনুনয় করে বিয়ে-নেমতন্ন সেরেই চলে যাবে। কিন্তু বিজিবি তাতে সাঁয় দেয় না। এখানে ইনডিয়ান মুসলিমদের দেখানো হয়, ইনডিয়ান হিসাবে তারা কেবল বিয়ের নেতমন্ন সম্পন্ন করতে আসছেন।
বিপরীত চিত্র বাঙালদের ক্ষেত্রে। বাঙালরা ভারত ঢুকছে চোরাচালন নিয়ে, মই দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছে। এ সময় ভোরে বিএসএফ'র গুলিতে খুন হলো একটা তরুণ।
বাঁশে ঝুলিয়ে লাশ নিতে অভ্যস্ত বিএসএফকে আমরা দেখি স্ট্রেচারে করে লাশ নিচ্ছে! আমরা ধারণা করতে পারি এ ঘটনা 'ফালানীর' ছায়া চিত্র। কারণ ঘটনার পর বিএসএফ'র উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে ' কমপ্লেক্স বর্ডার'। তাই এখানে মানবিকতা ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন বেহুদা! আমিও তাই মনে করি।
কিন্তু তাই বলে সীমান্তে হত্যা জায়েজ!
হতে পারে। কারণ বিএসএফ বলছে!
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিএসএফ কর্মকর্তা চরিত্র রূপায়নকারী বলছেন, তারা তদন্ত করে বিএসএফ জওয়ানদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন। সিনেমার শেষাংশ পর্যন্ত সে গল্পের বিষয়ে কোনো আলাপ আমরা দেখিনি।
সীমান্ত নিয়ে তার মন্তব্যও তাচ্ছেল্যের! রেডক্লিপ কিম্বা জিন্নাহ নেহরুকে জিজ্ঞেস করতে বলেন তিনি, কেন এ রকম সীমান্ত হলো।
আমরা আবার এও দেখি, বাংলাদেশের পত্রদূত কাগজের সাংবাদিক বিজিবি'র সাথে সীমান্ত দেখতে যায়, সীমান্ত সমস্যা দেখায় বিজিবি, বলে দেখেন তাল গাছের গোড়া বাংলাদেশে, মাথা ইনডিয়ায়। পিলার দেখান এবং হাজারের ওপর পিলারও নেই বলে জানান, যে গুলো নদীতে থাকতে পারত।
এখানে কি বিজিবি চরিত্র রূপায়নকারী সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছেন, নৌ সীমান্ত কি পিলার দিয়ে করতে হয়। একই সাথে সীমান্ত গ্রাম নিয়েও এখানে বিজিবি চরিত্র রূপায়নকারীদের আমরা তাচ্ছিল্য করতে দেখি--- দেখুন সীমান্তের গ্রামে কে কোন দেশের সেটা বোঝাও মুশকিল।
হতে পারে। তবে এ মুশকিল সামাল দেয়ার জন্য সীমান্ত রক্ষী। তারা এখানে সফলভাবে সিনেমায় উপস্থিত হতে পারত, সেটি কেন হয়নি প্রশ্নটা থেকেই যায়।
এখানে পত্রদূত কাগজের সাংবাদিক চরিত্রেও দেখি,বলছেন,'আমার মনে নয় সীমান্ত ঠিক করার সময় রেডক্লিফ নেশাগ্রস্থ ছিলেন।' তারক দাঁত কেলিরে হাসি !
একটি দেশের সার্বভৌমত্ব , সীমান্ত স্পর্শকাতর বিষয়, অথচ এ সিনেমাটির ক্ষেত্রে এটাকে মামুলি সিনেমেটিক ফরমেটে বিবেচনায় করা হয়েছে। এটা দুঃখজনক।
যে দেশে চাকমা ভাষায় নির্মিত সিনেমা 'মর থেংগারি'র মুক্তিতে সেন্সর বোর্ড গড়ি মসি করে, সে দেশে শঙ্খচিল এত সহজে কীভাবে হলের পর্দায় আসে, সেটি বুঝতে পারিনা !
আমরা প্রসেনজিৎকে দেখি নদীর তীরে বসে --- অন্নদা শঙ্কর রায়ের সে ছড়া কাটতে---'তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে/খুকুর পরে রাগ করো/তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!' ভারত ভাগে মনোকষ্ট তার।
বাদলকে আমরা দেখি একটা পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে অনেকগুলো চিঠি খুঁজে বের করতে, যেখানে তার পিতার সূত্রে প্রাপ্ত চিঠিতে বলা হচ্ছে, মুসলিমরা কীভাবে হিন্দুদের নিপীড়ন করেছে, চিঠি পড়তে পড়তে আমরা মুসলিম বাদল চৌধুরীকে পুড়তে দেখি, কষ্ট পাই।
আমরা এও একমত হই, যারা ধর্মের নাম করে অন্য ধর্মের লোকদের আক্রমণ করে তাদের ধর্ম ঘৃণা। তাদের ধর্ম কখনোই ইসলাম হতে পারে না। হিন্দু হতে পরে না!
সিনেমায় আমরা এটা দেখতে পারলে ভালো হতো, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমরাও একই রকম নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিক সত্য। এটা এডিয়ে গৌতম ঘোষ কি বার্তা দিতে চাইলেন, সহজে অনুমেয়!
সিনামায় আমরা মামুনুর রশীদকে দেখি সাতক্ষীরার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে, তার নাম- তপন বাগচী। বাদল চৌধুরীর খুব কাছের একজন; তার স্কুলেইর শিক্ষক।
বাদল স্যারের মেয়ে রূপসার হার্টের রোগ ধরা পড়ার পর তপন বাগচীর পরামর্শেই তাকে নেয়া হয়, সাতক্ষীরা ওপারে টাকী হসপিটালে। তপন বাবুর আত্মীয় চরিত্র রূপায়নকারী মিস্টার বাগচীর ফোন পেয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তার আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মত।
আমরা দেখি বাদল স্যার তার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে ইনডিয়া গেলেন, টাকীর সেই ভদ্রলোক তাদের বললেন, সীমান্ত আইন কড়াকড়ি। মেয়ের চিকিৎসার জন্য তাদের হিন্দু পরিচয় দিতে হবে। হসপিটালে তাই দেয়া হয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য রূপসাকে স্থানান্তর করা হয় কলকাতায়। সেখানে নিয়ত তাদের লুকিয়ে চলতে হয়। এখানে আমরা অবশ্য নামাজি বাদল চৌধুরীকে আবিষ্কার করি, যাকে আমরা দেশে বারবরই গান বাজনায় মগ্ন থাকতে দেখি, তিনি হঠাৎ সেখানে বিরাট মুসল্লী। তার স্ত্রীর সিঁথিতে সিঁদুর তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে,--- নিজের পরিচয় লুকানোর কষ্টের চিত্রায়ন। তবে একই সাথে তপন বাগচীর আত্মীয়'র তৈরি করে দেয়া অবৈধ নাগরিকত্ব সনদ দিয়ে কন্যার চিকিৎসার করানো দ্বিধাদ্বন্ধের সাথে লক্ষ্য করি। এখানে দ্বি-মুখিতা উপলব্ধি করবেন যে কেউ!
আমরা জানি সন্তানে জন্য মা বাবা যে কোনো কিছুই করতে পারেন, কারণ সন্তান সবারই প্রিয়! কিন্তু একের পর এক অপরাধ, ধর্ম, দেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য, জালিয়াতি--- সবই হয়ত মেনে নয়ো যায়, কিন্তু এর উদ্দেশ্য যখন চূড়ান্ত বিচারে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে ঘোষণা, তখন নিশ্চিতভাবে এখানে একটা ইল মোটিভ থাকতে পারে বলে, দর্শক হিসাবে সন্দেহ করার সুযোগ থাকে।
একটা লোক মুসলিম, যে তার কন্যাকে সত্য কথা বলতে শেখায়, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কন্যাকে হসপিটালে ভর্তি করায়। মারা যাবার পর সন্তানের লাশের ডিসচার্জ লেটার নিতে গিয়ে বাদল চৌধুরীর অনুতাপ প্রকাশ করে নিজেদের "অনুপ্রবেশকারী" ঘোষণা এক সাথে যায় না।
তারপর থানা পুলিশ। এর মাধ্যমে কি ভারতে বহু বাঙালকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দাবি জনতা পার্টির এজেন্ডার সফল চিত্রায়ন হলো!
লাশটা অবশ্য ফেরৎ পাঠানো হয় বাংলাদেশে। সে সাথে লাশ দাফনের পথে যাওয়ার সময় তপন বাগচীকে তার ইনডিয়া প্রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় রূপসার চাচা আনিস। এটাও বাংলাদেশের মানুষের হিন্দুদের প্রতি দুষ্টুমিচ্ছলে বলা কথা। এর সিনেমায় চিত্রায়ন নেতিবাচক ।
সাকুল্যে সিনেমার গল্পটা ঘুরপাক খায় সীমান্ত নিয়ে। সীমান্ত--- মানুষের জীবন বিপন্ন করে, স্বাধীন চলাফেরা আর বাঙালিত্বে অনেক বড় বাধা। এটাই সিনেমার ট্যাগ লাইন।
এ ধরণের সিনেমা আমাদের তিরিশ লাখ বা তারো বেশি শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা, দু'লক্ষ বা তততোধিক নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। সে ত্যাগের সহযোগিতা আমরা ইনডিয়ার কাছ থেকে পেয়েছি, সেটি স্বীকার করে নিয়েই বলছি--- এ ধরণের বার্তা, অখন্ড ভারতের আকাঙ্খা , সীমান্তকে কটাক্ষ করার সিনেমা শঙ্খচিল গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।

কোন মন্তব্য নেই: