খবরটা এমনভাবে আসবে, জানা ছিল না। সরদার স্যার চলে যাবেন, এটাও ভাবনার বাইরে। স্যারের শরীর খারাপ, এটা জেনেছিলাম। কিন্তু এভাবে আচমকা স্যার চলে যাবেন, মেনে নিতে পারছি না।
আমার জানা মতে, জ্ঞান তাপস রাজ্জাক স্যারের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে শেষ নির্মোহ ব্যাক্তি ছিলেন সরদার ফজলুল করিম স্যার।
আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল ২০০২ ও ২০০৩ সালে। তার পর আরো কয়েকবার। তাঁর সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল একবারই।
তার বইয়ের সাথে পরিচয় ১৯৯৯ সালে। ক্লাসে ঢুকেই জানতে পারলাম, স্যারের প্লেটোর রিপাবলিক অনুবাদ করেছেন, যেটি আমাদের পাঠের জন্য কেনা দরকার।
তবে মানুষ হিসাবে সরদার স্যারকে আবিষ্কার করি আরো কিছুদিন পরে, ২০০২ সালে। রাজ্জাক স্যার '৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর মারা যাবার পর তাকে নিয়ে আলোচনায় যে দু'জন মানুষকে আমি চিনতে পেরেছি; তার একজন সরদার স্যার। আরেকজন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। তবে সরদার স্যারের সাথে পরিচয় এবং আলাপ দু'টোই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথাও বলেছিলেন, সে সময়।
২০০২ সালে ডাকসু ভবনের সামনে একজন হালকা পাতলা মানুষ রিকশা থেকে নামলেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। ডাকসু সংগ্রহ শালার গোপাল দা এগিয়ে আসলেন। স্যারের মুখটা দেখেই মনে করতে পারলাম বইয়ের পাতায় দেখা ছবিটার সাথে মিলে যাচ্ছে।
পরিচিত হলাম স্যারের সাথে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ছি শুনে খুশী হলেন। ডিপার্টমেন্টের খোঁজ খবর নিলেন। গোপাল দা আমার সে সময়কার সম্বাদিক পরিচয়টাও স্যারের কানে দিলেন।
বিম্পি সরকারের সময় ছিল সেটি, রাজনীতি নিয়ে স্যারের সাথে অল্প কয়টা কথা হয়েছে। তিনি রাজনীতির চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়লের পুরনো দিনের গল্প করলেন। বললেন, এখন সব কিছু কেমন হয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির দিকে নজর দিতে হবে।
স্যার বললেন, তোমরা যেহেতু স্টুডেন্ট এবং জার্নালিস্ট। তোমাদের উচিৎ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যাতে নজর দেয় সে জন্য লেখালেখি করা। পড়ুয়াদের উৎসাহ দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা। সাধারণত যারা জ্ঞান চর্চা করে থাকেন, তারা প্রচার নিয়ে মাথা ঘামান না।তাই তাদের কাজের সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে!
স্যার বরিশালের উজিরপুর থেকে ঢাকায় আসার পর ঢাকার যে রূপ দেখেছেন, সেটিও জানালেন। বললেন, এই যে তোমরা যানজট দেখো, আবর্জনা দেখো। এটা কিন্তু আমাদের মনের ভেতরও আছে। আমরা যদি নৈতিকভাবে হতে না পারি; তাহলে কোনো কিছুই ভালোভাবে করতে পারবো না।
যত পড়বে, তত জানবে। যে পেশাতেই থাকো, পড়বে। রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে যেহেতু পড়ছো, রাজনীতির শুদ্ধতার জন্য কাজ করো। আমরা এখন আর কিছু করতে পারবো না। তোমরা করবে।
এভাবে অনেক কথা। প্রায় ঘন্টাখানেক। গোপাল দা স্যারের কয়েকটা ছবি তুলে রাখলেন। গোপাল দা'র সংগ্রহে স্যারের অনেক ছবি আগে থেকে আছে। গোপাল দা সেই বার স্যারকে বলেছিলেন, স্যার আপনি আমার বাসায় চলে আসেন। আমি আপনার খেদমত করার সুযোগ চাই।
স্যার স্মিত হাসলেন। বললেন, গোপাল তোমার কাজ ভালো চলছে।
এরপরও স্যারের সাথে দু'তিনবার দেখা হয়েছে। আজিজ মার্কেটেও স্যারকে দেখেছি।
ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর এতগুলো বছর গেলো- কেবল স্যারের বই পড়ছি, কিন্তু স্যারের কাছে যাইনি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানের বাতিঘর নিভে গেছে।
স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি, অগ্রগতি, গবেষণা ও নতুন নতুন বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি কথা সব সময় বলতেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা থেকে অবসরের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা মজবুত করার জন্য স্যারের যে আকাঙ্খা দেখেছি, সেটি সমকালীন অন্য শিক্ষকদের চোখে দেখিনি(অল্প কয়েকজন ব্যাতিক্রম আছেন। যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম স্যার)।
মূলত দর্শনেই স্যারের পড়াশোনা। কিন্তু রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে তিনি এসেছিলেন রাজ্জাক স্যারের অনুরোধে। রাজ্জাক স্যার দিল্লির ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ব্দ্যিালয়ের আড়াইশ টাকার মাইনের চাকরি নিয়ে এসছিলেন, এ বঙ্গদেশে একটি অনন্য বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্নে। সেই স্বপ্নের সারথী সরদার স্যাররা।
আজ তার বিদায় দিবসে শ্রদ্ধা জানাই। স্যার পরপারে ভালো থাকেন। স্যার যেদিন বিদায় নিলেন, সে দিনটি আন্তর্জাতিক বাবা দিবস। বিদায় প্রিয় পিতৃ শিক্ষক। বিদায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন