কিস্তি ::৮৯:: পর্যটন, বাঘ, টেনশন, নিরাপত্তা এবং আমার উদ্যোক্তা রহস্য


'পর্যটন শিল্পের বিকাশের আন্দোলন'র কর্মী হিসাবে কাজ করছি, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যারের এস্কারশনে শিক্ষার্থীদের নিতে চান না। কারণ ব্যাখ্যা করে  রসায়নের অজয় স্যার আমাকে বললেন, কোথায় যাবো, নিরাপত্তার কি হাল, এ সব নিয়ে টেনশন।

২০০৪ সালের এক দুপুরে কার্জন হলে তার অফিসে এভাবেই তার সাথে কথা হচ্ছিলো। বল্লাম, স্যার টেনশনের কোনো কারণ নেই। দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি। স্যার ভরসা পেলেন বলে মনে হলো না। তবুও বললেন, দেখি।

স্যারের সাথে আলাপের পর আমার মনে হলো পর্যটন স্পটের নিরাপত্তা, থাকার ব্যবস্থা, যাতায়াত ও  সাইট সিয়িং সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি করা দরকার।

সে জন্য ছাত্র উপদেষ্টাদের দপ্তরে গিয়ে এটা নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। আমার সাথে এ আলাপে  ট্যুরিস্ট সোসাইটির সদস্যদের কাউকে কখনো হাতের কাছে পেলে নিয়ে যেতাম।

শেষ পর্যন্ত অজয় স্যার তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেলেন সেন্টমার্টিন। আমার খুব ভালো লেগেছিন, স্যার আমাকে আস্থায় এনেছিলেন বলে। পরের কয়েক বছর আমরা বেশ কয়েকটি ট্যুরের আয়োজন করে দিলাম।

আয়োজনটা করতে হয়েছিল ভিন্ন কারণে-আমাদের দেশের ট্যুর অপারেটরদের নম্বর দিয়ে আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাঠাতাম। তারা একটা ট্যুরের জন্য যে চার্জ করতেন, তা  খুবই 'অসঙ্গত' মনে হয়েছে আমার কাছে।  শিক্ষার্থীরা এসে বলত- 'ভাই এত টাকা দিয়ে কি ট্যুর হবে!'

ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন ছাত্র আমার কাছে এলেন, ২০০৫ সালে। তারা একটা স্টাডি ট্যুর করতে চান। সে জন্য আমাদের হেল্প দরকাল। সব আয়োজন করা হলো। শামসুল আলম স্যারের  সাথে আমি গিয়ে কথাও বলে আসলাম।

আমার অনুজ বাপ্পী ও সামিউল হক শামীমকে পাঠালাম তাদের সাথে। সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার, রাঙামাটি-বান্দরবান ঘুরে তারা সহিহ সালামতে ফিরে এলেন।

ঢাকায় এসে হিসাব করে দেখি  শামীম আর বাপ্পী দুহাজার টাকা লস করে এসেছে। পরে সে টাকা আমি  দিয়েছি। অবশ্য বাড়তি টাকা খরচ করায় বাপ্পী আর শামীমকে একটু বকাও দিয়েছিলাম।

একই বছরে আইন বিভাগের ছেলে মেয়েরা বলল- তারা কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন  বেড়াতে যেতে চায়। এবার ইসলামিক স্টাডিজের বাজেটটা মাথায় রেখে, যাতে লস না হয় সেভাবে প্ল্যান দিলাম।  তারা আরো কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি শেষে, আমাদের বল্ল- আমরাই যেনো সব এন্তেজাম করি। করা হলো।

আমার বন্ধু মিল্লাত ছিল সেই ব্যাচে। আরেকটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিন, তার নামটা মনে  নেই। আমি সব ম্যানেজ করে দিলাম। যা খরচ হওয়ার কথা তার চেয়ে কম খরচে তারা ট্যুরটা করে আসলো। খুবই আনন্দময় ও সফল ট্যুর হয়েছে বলে তারা ঢাকায় ফেরার পর আমাকে জানিয়েছিল।

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনে একটা ট্যুরের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের একটা ব্যাচ যাবে। কয়েকটা ছেলে মেয়ে আসলো ডাটসের অফিসে।

বল্লাম- পরামর্শ চাইলো সুন্দরবন যাওয়ার জন্য ভালো  সুবিধা ও প্যাকেজ কারা দেয়। পর্যটন করপোরেশন সে সময় সুন্দরবন ট্যুর করাতো, তাদের ঠিকানা দিলাম। সাথে গাইড ও বেঙ্গল ট্যুরের ঠিকানা।

ওরা আরো কয়েক জায়গায় ঘুরে আসলো। পর্যটন করপোরেশন ৩ দিনের ট্যুরের জন্য কমপক্ষে সাড়ে ৪ হাজার টাকা ফি  চেয়েছে। আমি আগেই বলেছিরাম, ট্যুরিস্ট সোসাইটি করালে ২৫০০ টাকায় ম্যানেজ করা সম্ভব। তবুও ওরা বাইরে চেক করে ফিরেছে।

ফেরার পরে  ওরা বল্ল আমরা ম্যানেজ করলে চলবে না।  আমাদেরো যেতে হবে।  তখন ফি বেড়ে ২৮০০ টাকায় ঠেকলো। কারণটা হলো ট্যুরটা ম্যানেজ করার জন্য আমাদের অন্তত ৬ জনকে যেতে হবে। তারা সংখ্যা ৩২ জন। তাহলে ৬ জনের খরচ এবং তাদের অন্তত একটা করে শার্ট কিনে দেবার  টাকা ধরে এই ফি। আগে ২৫০০ টাকা ফি ধরার সময় এ সব হিসাব টা ছিল না।

ওরা তাতেই রাজি।

ঠিক করা হলো এমভি পানকৌড়ি। দোতলা লঞ্চ। বাসে মংলা হয়ে সেখান থেকে সরাসরি লঞ্চে। বাগের হাটের স্থানীয় সাংবাদিক রবিউল ভাই ও মংলার মনিরুজ্জামান কবীর খুব হেল্প করেছিল। মংলা থেকে তিন দিনের রসদ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। যাওয়া মাত্র সবই তোলা হলো।

সকালের নাশতা খেতে খেতে লঞ্চ চলছে। সেই ট্যুরে আমার সাথে লিপি, সাদিয়া, মিটি, শামীম, মামুন এবং আমানত ছিল।  আমরা  হৈ হুল্লোড় করে বেশ কাটিয়েছি।

পশুর নদীর জলে, জোছনা রাত। লঞ্চ চলছে। হরিণ টানায় আমরা বিরতি দিলাম। ছোট ছোট চারটা ঘর। ফরেস্টের লোকজন থাকেন। রাতে আমরা নামলাম সেখানে।

বন বিভাগের লোকজনের সাথে আলাপ হচ্ছিলো- ক'দিন আগেও এখান থেকে 'বাঘে মানুষ নিয়ে গেছে' টাইপের গল্প শুরু করলেন তারা। কিছুক্ষন আড্ডার পর আমরা লঞ্চে ফিরে এলাম।

জোছনায় ভেসে যাচ্ছে পশুরের জল। বন গাছের পাতার ভেতর লুটুপুটি খাচ্ছে কুমারী জোছনা।  সে কী মহা আনন্দ উচ্ছ্বাস সবার। গানে-গল্পে অনেক রাত। খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুম।

সকালে লঞ্চ ছুটলো কটকার দিকে। সেখানে নামা হলো। অনেক্ষণ কাটানোর পর আমরা  জামতলী বিচে ভিজতে গেলাম। ওয়াচ টাওয়ার হয়ে লঞ্চে ফিরছি। এর মধ্যে মাঝপথে ইঞ্জিন নৌকাটা নিয়ে একদল তরুন-তরুণী অন্যদিকে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলো ইঞ্জিন।  টেনশন- চরমে। ছেলে পুলো সবাই আমাকে ঘিরে আছে। ভাই এখন কী হবে। ট্রলার তো সাগরের দিকে চলে যাচ্ছে।

বল্লাম- তোমরা যও। একজন এক প্যাকেট এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এগিয়ে দিলো, পাশ থেকে আরেকজন বল্ল, ভাই বেনসন খায় না। গোল্ডলিপ খায়। আরেকটা ছেলে দৌড়ে এক প্যাকেট গোল্ডলিপ নিয়ে আসলো। শামীম সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছে।

ভাবছি কী করবো-
পরে লঞ্চের মাস্টারকে বল্লাম লঞ্চ স্টার্ট দ্যান। মাস্টর আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে। লঞ্চ নৌকার কাছে গেছে নৌকা ডুবে যাবে। বল্লাম ডুবে গেলে  নদীর জল থেকে মানুষ তোলার অভিজ্ঞতা আমার আছে।  চলেন। স্টার্ট নিলো লঞ্চ। শামীম আর  মামুন লাইফ  বয়া নামিয়ে আনলো।

ধীরে ধীরে লঞ্চ গিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছালো।  সবাইকে তুলে আনলাম। নৌকায় থাকা সবার ধারণা ছিল- খুব বকা দেবো। আমার মুড আর  আর একটার পর একটা সিগারেট  ফোঁকা দেখে সবাই ভয় পেয়েছিল।তাতেই যথেষ্ট। কিচ্ছু বল্লাম না।

দুপুরের খাবারের সময় সবাই ফের সতর্ক করলাম।  নির্দেশনার বাইরে কিছু করা যাবে না। স্বর্ণা নামের একটা মেয়ে বরাবরই নিয়ম ভাঙ্গার পক্ষে। ওর দিকে তাকিয়ে কথাটা আরেকবার বল্লাম।  মাথা নিচু করে বলল- ভাই ঠিক বলেছেন।

আবার ওরই বান্ধবীরা পেছনে এসে আমাকে বলে স্বর্ণা আমার ওপর খুবই বিরক্ত।

আমার খবরদারি সবচেয়ে বড় কারণ হলো- এ ট্যুরে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের কোনো শিক্ষকই আসেননি। শিক্ষকরা আমাকে বলেছেন, আমি যেনো তাদের দায়িত্ব পালন করে  শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ঘুরয়ে আণি। তাই আমার জন্য যে কোনো রকমের শাসন জায়েজ ছিল!

দুপুর তখন দুইটা কি আড়াইটা। সবার মুখ থেকে ভয়ের ছাপ কমে গেছে। কানের কাছে কেউ কেউ এসে বলছিলো, ভাই বাঘ কি দেখা যাবে। বল্লাম আশা ছেড়ে দাও। কিন্তুি  কী আশ্চর্য। আমরা মাত্র  কচিখালী টাইগার পয়েন্টে এসে নামলাম। কেউ কেউ পুকুরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে বল্লাম চলো শন খেত মাড়িয়ে আসি। কথাটা শুনে সবাই উচ্ছ্বসিত।

এর মধ্যে শন ক্ষেতের মাথায় বনের ভেতর থেকে বাঘ মামা উঁকি মারলেন।  সামনে কয়েক পা এগুলেন। এত্ত মানুষ একসাথে দেখে পালাবে, নাকি সামনে এগুবে এ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল (নিজের বাঘ বিশেষজ্ঞ মনে লইতাছে)। আমরা সবাই দ্বিধা দ্বন্দে- এইটা কী বাঘ! নাকি হরিণ। নাকি বড় বন কুত্তা।

সাথে থাকা বনরক্ষী এবং স্থানীয়  ফরেস্ট অফিসার এসে বললেন, আপনাদের ভাগ্য ভালো বাঘ দেখে গেলেন। আসলেই ভাগ্য ভালো।  জীবনে দুইবার সুন্দরবনে উন্মুক্ত বাঘ দেখেছি। সেবার ছিল দ্বিতীয় ঘটনা। সবাই এতটা আনন্দিত যে দুপুরে খাবারের কথায় যেনো ভুলে গেলো।
     
ঢাকায় ফেরার পর জানলাম স্বর্ণা রোকেয়া হলে তার  সব বান্ধবীদের জানিয়েছে সুন্দরবন ট্যুরটা অসাধারণ হয়েছে।

এই ট্যুরের পরই আমি নিশ্চিত হলাম, সফলভাবে ট্যুর অপারেট করা  সম্ভব। কাজটা আমি করতে পারি। সেটা লাভজনক ব্যবসা হতে হবে, তা কিন্তু নয়। এটা এক ধরণের সেবা হবে। ট্যুরিস্ট সোসাইটিতে আমার মেয়াদ পূর্ণ করার পর চূড়ান্তভাবে আমি এ কাজটা করে আসছি। এ থেকে যে আমার আয় হবে এবং তা দিয়ে সংসার চালাবো, এমন ভাবনা ছিল না। এখনো নেই।

লক্ষ্য একটাই সাশ্রয়ী মূল্যে ভ্রমণ নিশ্চিত করা। এই একটি জায়গায় আমি নিজেকে সফল হিসাবে মূল্যায়ন করতে পারি।  :P 

কোন মন্তব্য নেই: