ঘোরলাগা- রিছং কিম্বা বৃষ্টিস্নাত পাহাড়!




ঠক ঠক করছে কাঁপছে নাজিব- আমি তখনো ঝরণার জলে। এমুন যৌবনা ঝরণা ছেড়ে আমরা কেউ ফিরতে চাইলাম না। আগের দিনে ২১ ঘন্টার জার্ণির ক্লান্তিটা মুহুর্তে মুছে গেলো- ঝরণার জলে সতেজ সবাই। খাগড়াছড়ির রিছংয়ের  এ ঝরণার পথে নামতে নামতে কিছুৃটা হাঁপিয়ে ওঠার পর আমরা সেখানে। বৃষ্টি আসছে, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি- এমন বৃষ্টি  পাহাড়ে ইন্দ্রজাল তৈরি করে; স্বপ্ন ছড়ায়, বয়সটা কমিয়ে দ্যায়!

১৪ আগস্ট বিষুদবার রাইতে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সৌদিয়া পরিবহনের অবস্থা বেশি ভালো না। সার্ভিস  খুবই খ্রাপ এইটা জানতাম; তয় এত্ত খ্রাপ, সেটা জানা হলো এবার।

যাওয়ার দিন দুপুর বেলা সৌ্দিয়া অফিস থেকে ফোন-  'রামগড়ে পাহাড়ি ঢল। মানুষ পানি বন্দী। বানের জলে ভেসে গেছে  বেইলি ব্রিজ। বিকল্প রাস্তায় চট্টগ্রাম হয়ে গাড়ি যাবে। অন্য বাস গুলো যাত্রা বাতিল করেছে!'
সৌদিয়ার দিলে অনেক দয়া , তাই কিছু বাড়তি মাল খসালে তারা আমাদের নিতে প্রস্তুত। রাজি হলাম-

বিপত্তির শুরু হলো শুরুতেই।  রাত এগারটার গাড়ি, ছাড়লো ১১ টা ৪০ এ। দাউদকান্দির পরে-  চাক্কা পাংচার। ড্রাইভার কইলো নতুন চাক্কা রাইতেই লাগাইছে। বোঝেন রাস্তার কী অবস্থা!
নেমে এলাম, এই বৃষ্টি এই মেঘ। কিন্তু চাক্কা ঠিক করনের জোগাড় নাই। মালিক বক্করের লগে টক্কর হলো, কিন্তু চাক্কা ঠিক করতে ইশতিয়াককে নামতে হলো রাস্তায়। কভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারকে রাজি করিয়ে চাক্কা বদলের আয়োজন হলো।

ঘণ্টা আড়াইয়ের মামলা শেষে বাস চলছে।  মাঝখানে বিরতিতে  সক্কালবেলার নাশতা।  সীতাকুণ্ডের আগে পাক্কা ৬ ঘণ্টার জ্যাম। এত্ত জ্যাম, সবাই বিরক্ত!  হাইওয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কম্মকর্তা জানালেন, পুলিশ সুপারকে কল করতে-পুলিশ সুপার জানালেন- রাস্তায় গাছ পড়েছে, তাই জ্যাম। আসলে হাইওয়ে পুলিশ যে, 'হাওয়ায়' পুলিশ তা বোঝা গেলো পরে; কারণ পুরো রাস্তায় একটা গাছের ডালও ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেলো না।

বিকাল সাড়ে তিনটায় অক্সিজেন মোড় হয়ে বাস চলছে, মনে হলো আর না! নেমে পড়ি! কিন্তু রিছং ডাকছে; তাই ছুটছি। রাত আটটায় মিলনপুরে  গাইরিং হোটেলে ঢুকে মনে হলাে - আহা স্বস্তি!
বার বার মনে হচ্ছিলো আমার হাঁটা বাবার কথা,  রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, সেটার চেহারা যে ক্ষয়ে যাওয়া রাজনীতিরই আরেকটা  চিত্র; তবুও হাঁটাবাবার কথার খই ফোটে।বক্তৃায় মাইক গরম হয়। সেলুকাস, বিচিত্র এক চিড়িয়া! 

তবুও ভ্রমন-খাগড়াছড়ি।
রাতের খাবার গাইরিংয়েই হলো- দুপুর বেলার খাবার টাকা পুরাই সেভ! মুরগি, সবজি আর ডাল- অমৃত সমান। ত্রিপুরাদের রান্নার হাত খ্রাপ ছিলনা কোনোকালেই, এখন আরো ভালো হয়েছে।
 অনন্ত ও চয়ন দা' দ্বয়ের স্ত্রীদ্বয়ের যৌথ প্রযোজনার এ খবারের পর ঘুম ছাড়া বিকল্প রাখা সম্ভব ছিল না।

ফাঁকে মামুন আর আমি চলে গেলাম শাপলা চত্বরে, চান্দের গাড়ি রেড়ি করা হলো। সক্কাল বেলা ঢাকায় থাকলে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে  ১১ টা। কিন্তু বেড়াতে গেলে ৭ টায় উঠে পড়ি- এবারো তাই হলো।  চান্দের  গাড়ি এসে পড়েছে, কল দিলো ড্রাইভার- দাদা নামেন! কইলাম খারাও ৯ টার আগে নামনের কোনো চিন্তা নাই।

নাশতার পর্ব সমাপ্ত করার পর ঝরঝরে সবাই। কেবল নাজিব ক্লান্ত। পানি যার সবচে প্রিয় সে তার সব ক্লান্তি মুছে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে  ছুটছে রিছংয়ে। নাকিব পানি ভয় পায়। সে গুৃটিসুটি মেরে বসে থাকতে পারলেই বাঁচে; কিন্তু যখনই বাসায় আসবে- বলবে বেড়াতে যাবো!

রিছংয়ের আগে একটা টঙ দোকানের  সামনে চান্দের গাড়ি থামতে, একজন পাহাড়ি হাত তুলে বল্ল ২০ টাকা দ্যান। গাড়ি রাখার  টোল। কিন্তু কোনো স্লিপ নাই, তাতে কী। চল নিচে নামি।

ইশতিয়াক  যে এত রোমান্টিক এইটা আমার জানা ছিল না,  বউয়ের ছবি  ক্যামেরা বন্দি করতে করতে নামছে বেচারা। আমরা একটু এগিয়ে গেছি। রীতি তার স্বভাব সুলভ গল্প বলে যাচ্ছে, আমি মামুনের সাথে আড্ডা-মগ্ন। অনেক দিন পর মামুন আমাদের সাথে ট্যুরে। তাও হঠাৎ আমার ফেসবুকে দেখে। ভাগ্য ভালো নাজিবের জন্য একটা সিট রাখা ছিল, সেটা ওর চাচ্চুকে ছেড়ে দিয়েছে!

পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ-বৃষ্টির যে মোহনীয়  কামাতুর রূপ তৈরি করলো, তাতে সবাই বিমোহিত, কিন্তু এর বর্ণণাটা সবাই একটু কবিত্ব  দিয়ে করার চেষ্টা করছে।  আসলেই সুন্দর... এ শব্দটার মানে হলো এ সুন্দরের সাথে কোনো তুলনা চলে না।

 মাঝখানে একটু বিরতি দিয়ে রিছংয়ের নিচে আমরা,  স্রোতের তোড়ে  ভেসে যাচ্ছে জঞ্জাল, ছড়া ভর্তি পানি, আমরা পাহাড়ি রাস্তার ধরে উঠে এলাম উপ্রে।  রিছংয়ের জলে ছোয়া নিলাম অনেক্ষণ, কিন্তু পিচ্ছিল  পুরো এলাকা- দুর্ঘটনা মানে নিশ্চিত অঙ্গহানি!

তবুও মন মানে না। ইতোমধ্যে ঝরণার জলে নাজিবের কাঁপুনি ধরে গেছে।  তাকে নিচে নামিয়ে রেইন কোট পরিয়ে রাখা হলো। রীতি -শিপু  ব্যাগ আগলে রাখছে।

শেষতক সবাই  ঝরণার জলে। একটু ঘূর্ণি খেয়ে ঝরণার জলের তলে নিজেদের সঁপে দিলাম- নে বাবা জল থেরাপি উপভোগ কর।  এভাবে অনেক্ষণ, শিপুর হাত ঘড়ি তুলে বল্ল সাড়ে ১২ টা বাজে। ১ টার দিকে আমরা উপ্রে ওঠা শুরু করলাম। কিন্তু এ রকম একটা কলরব তুলে ছুটে যাওয়া পাহাড়ি যৌবনবতী ঝরণা ছেড়ে আসাটা  খুব কষ্টের- তবুও  আসতে হয়।

 চান্দের গাড়ি ছুটছে, গন্তব্য সিস্টাম। এটা মারমা রেস্টুরেন্ট, আগের রাতে মামুন আর আমি কইতরের মাংস, বাঁশ করুল আর থানকুনি পাতার সাথে শুটকির ঝোলের অর্ডার করে গেছিলাম। সেই মতে রান্না হবার কথা। সবার পেটে সেই রকম ক্ষুধা।  আচিং অভ্যর্থণা জানালো। বসালো, সাথে বললো বাঁশ করুলটা পাওন যায় নাই। মেজাজটা খ্রাপ হলো- কইলাম এই জন্য অগ্রিম অর্ডার; বেচারা খুব লজ্জা পেয়ে জানালো রাতে এ আয়োজন হবে সেই রকম।   

ক্ষুধার্তরা হামলে পড়ছে সিস্টামে; আমরা খাইতে থাকলাম, বাঁশ করুলের  বদলে লাউ চিংড়ি। কইতরের ঝোলাটা নাকি সেই রকম জানালো, রীতি, রিংকি এবং লিনা।

তৃপ্তি ভরে সবাই খেয়েছে; সে আওয়াজ পাওয়া গেলো পরে-
ফের যাত্রা। গন্তব্য আলুটিলা গুহা।  বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে আমরা নেমে এলাম। গুহা জয়, আমড়া ভক্ষণ এবং ছব্বি তোলার আয়োজন। ৫ টাকার টিকিট নিলেও নিরাপত্তার কোনো আয়োজন সেখানে নেই। তবুও আলুটিলা- মিস করার কোনো সুযোগ নেই।  গুহার অন্ধকারে ঢোকার পর মনে হলো বয়স হযেছে- চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মনে লয়; একটু ভয়ও!

মধ্যপথ থেকে শিপু প্রস্থান করলো, ইশতিয়াক আগেই স্বশালী এবং স্বস্ত্রীক প্রস্থান করেছে। শিপু কইলো- ভাই, আপনি যখন কনফিডেন্স পাইতেছেন না, তাই  আর যামুনা। কারণ অইলো প্রথম আমি, মামুন আর শিপু ঢুকলাম- কিন্তু ভ্রিত্রে  যে জলের স্রোত তাতে সাহস হচ্ছিলো না।
তৃতীয় দফায়  পানিতে ভিজে  গুহার পারের  চেষ্টায় শিপু বিরত হলেও মামুন বললো- ভাই যামু, চলেন। আবার কবে আসি ঠিক নাই। আসলেই তো ঠিক ২০০৭ এর পরে ২০১৪ তে মামুন আর আমি এক সাথে।

শেষ পর্যন্ত গুহা অতিক্রম করা হলো-

ফেরার পথে মনে হলো বৌদ্ধ মন্দিরটা সুন্দর- দেখে যাই। সেখান থেকে ছব্বি তোলার পর আমরা জেলা পরিষদের নতুন করা ঝুলন্ত ব্রিজে গেলাম, ব্রিজটা সুন্দর হয়েছে। তবে বেশি সংখ্যক পর্যটকের চাপ সইবার ক্ষমতা তার নাই! তবুও ব্রিজ দেখা হলো; এর আগে  চান্দের গাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে ব্যাথা পেয়েছে মৌ এবং রিংকি।  পা ফুলে গেছে। কিন্তু  না, মিস কেউ করতে চাইনি।

দিলিপ বললো- দাদা কই যামু। চলো কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট। সেইখানে একই ঝামেলা- গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে গেলে ঢোকা যায় না! আবার বউ পুলাপাইন লইয়া গেলে কয় সময় শ্যাষ। কিন্তু আমরা তো ঢুকতে গেছি। সন্ধ্যার একটু আগে। আমরা  ইন্সটিটিউটের  লেকে এবং তার ওপর ঝুলন্ত  সেতুতে গেলাম। সাধারণত এতটা পথ কেউ আসে না। সেখানে যাবার পথে রীতি- রীতিমত আছাড় খেয়ে ব্যাথা সমেত উপস্থিত। বেচারি; খ্রাপ লাগছিল। না আসলেও পারতাম -কিন্তু ওই যে মিস! না মানে বাদ দিযে চাইনি স্পটটা।
এবার গন্ত্য সেনা কাফে। সাধারণ ক্যান্টনম্যান্টগুলো সুন্দর কাফে থাকে, যেখানে  সাশ্রয়ী মূল্যে  ভালো খাবার পাওয়া যায়। দিলীপ আমাদের গিরি পিজায় নামিয়ে দিলো-  জানা গেলো এ রেস্তোরা প্রাইভেট-আর্মি পার্টনার শিপে চলে।
 খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত ৮ টা।  শেষ পর্যন্ত স্যুপ আর রসমলাই খেয়ে প্রস্থান।

রাত ১০ টায় সিস্টেমে হাজির আমরা।  ব্যাম্বো চিকেন, বাঁশ করুল ভাজি, বাঁশকরুল  ও কলা গাছ সেদ্ধ , সাথে বাঁশকরুল দিয়ে ডাল- কবুতরের  রোস্ট; সেই রকম একটা খাওয়ার আয়োজন।
ব্যাম্বো চিকেন নিয়ে সবাই  উৎসাহিত, ভিত্রে যে পাতা পাওন গেছে সেটা কী লেবু পাতা না অন্য কিছু- সেটি উদ্ধারে ব্যস্ত। আচিংকে ডেকে সমাধান করা হলো সেটি নুরং পাতা। তার একটা তাজা পাতার ডাল আনা হলো- সবার দেখার জন্য। সেই রাতটা খাবার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, রেস্তোরার মালিক ও কর্মীরা সবাই এর জবাব দিচ্ছেন উৎসুকদের।  আমার দুই পুত্র নাজিব নাকিব সহ আমরা ১০ জনের গ্রুপ!

রাত সাড়ে ১১ টা। সবাই হোটেলে। সকালে ঘুম ভেঙ্গে শিপু আর আমি গেলাম  টিকিট আনতে। শান্তি পরিবহন; গন্তব্য চট্টগ্রাম। তার আগে স্থানীয় একটা মফিজ হোটেলে খাওয়া দরকার। তাই সকালের নাশতার আয়োজন করা হলো তুলনামূলক উন্নত মফিজ রেস্টুরেন্ট ভাত ঘরে।

শান্তি- শান্তি পরিবহন ছুটছে চট্টগ্রাম।  চার ঘণ্টা অক্সিজেন মোড়ে গাড়ি থামলো মকবুল  মাইক্রেবাসটা নিয়ে আসলো- চড়ে বসলাম সবাই। যাচ্ছি পতেঙ্গা। কইলাম খাওন অইবো না দুপ্রে।  রিংকি ইশতিায়াককে বলেছে- ক্ষুধা লেগেছে। অন্যরা বলছে না। তার মানে এই নয়, অন্যদের ক্ষুধা লাগেনি। 'দাবা'য় দাঁড়ালাম আমরা। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানী প্যাক করে খেতে খেতে  পতেঙ্গা। রাস্তায় অস্বস্তিকর জ্যাম।

এর মাঝে ঢাকা ফেরার আয়োজন । ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেলো না, বাসের টিকিটও না। শেষ পর্যন্ত মাসুদের সহায়তায়  হানিফ খাঁটি নন এসি মফিজ পরিবহনের টিকিটি কেটে আমরা ঢাকা ফেরার জন্য প্রস্তুত।

পতেঙ্গায় নাজিব বারবারই জলে নামতে চাচ্ছে।  পিতার মত পুত্রেরও সাগর-নদী প্রিয়। যদিও তার মায়ের আকাশ প্রিয়! তাকে সামলে নিতে নিতে, আর  স্ত্রীগণের কেনাকাটায় রাত সাড়ে ৯ টা। ফিরঠছ চট্টগ্রাম শহরে।

ফেরার পথে আমাদের সেই পুরনো গান- এক জোনাকী ,দুই জোনাকী, তিন জোনাকি গাইলাম মামুন আর আমি।  সেই গানের শানে নজুল বর্ণনা করলো লিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যখন ট্যুরে যেতাম এ গানটা আমাদের সাথে বাজত-নিজেদের কণ্ঠে। শিপু সেটি আবার ইউটিউব থেকে আমদানি করে শোনালো।

রাতের খাবারটার আয়োজন হলো জামান হোটেলে- এ রেস্টুরেন্টের খাবার  ও  সেবার মান যে কোনো সময়ে তুলনায় কেবল খারাপই হয়নি, যাচ্ছেতাই ধরণের-  তা বোঝা গেলো। তার পরেও
মাটন কারি ডাইল সাথে আতপ চাইলের ভাত- খাওয়া শেষ এবার গাড়ির জন্য অপেক্ষা।

হানিফ বাস চলছে না রকেট চলছে টের পাচ্ছি না।  ভোর হবার আগেই কাঁচপুর। ৬:২১ এ আমরা ঢাক্কায়। পেছনে পড়ে থাকলো খাগড়াছড়ি-সিস্টাম আর পতেঙ্গার সন্ধ্যা। সেই সাথে প্রশ্ন: হাঁটাবাবা আর কয় টার্ম কমিউনিকেশন মিনিস্টার থাকলে এই রাস্তা ঘাট ঠিক অইবো!     

কোন মন্তব্য নেই: