নোট: এ রিপোর্ট ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট করা । এর মধ্যে নিশ্চিতভাবে বহু কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তবে মূল রিপোর্ট ঠিক রাখার জন্য ভেতরে তথ্য ও বক্তব্য অদল বদল করা হয়নি। একটা তথ্য আগে জানিয়ে রাখি- বোমাং সার্কেল রাজা অং শৈ প্রু মারা গেছেন। এখন নতুন রাজা বান্দরবানে।
সাঙ্গু --- মুরংরা যেখানে শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন!
গরু ‘সিল’ মারাটা মনে আছে ইয়ং চিং ম্রো’র। ছোট বেলায় তারা গরু সিল মারার সময় বাঁশি বাজাতে বাজাতে নাচতেন। এখন নাচেন না। ধর্ম বদলে গেছে। উদ্ধার হয়েছে তাদের মাতৃভাষার বর্ণমালা। তাই বৌদ্ধ ধর্ম থেকে তারা নয়া ধর্ম ক্র্যামা ধর্মে যুক্ত হয়েছেন। তারা নিজেদের ধর্ম নিয়েই ব্যস্ত। এর ভেতর আবার অনেকে ধর্ম বদলেছেন। গ্রহণ করেছেন খ্রিস্টান ধর্ম।
গরু সিল মারা মানে--বছরে মুরং বৌদ্ধরা একটা অনুষ্ঠানে মিলিত হয়। সে সময় তারা গরু ধরে একটি বাঁশের ঘেরা দেয়া জায়গায় বন্দী করে। নাচের তালে তালে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওই গরুটিকে মেরে ফেলা হত। এটাই গরু সিল মারা।
ধর্ম বদলের বয়ানে ইয়ং ম্রো বলছিলেন, ‘অনেক লাভ। টাকা দেয়। যাজক হিসাবে চাকুরি দেয়। সাথে স্বচ্ছন্দময় জীবন। লোভে পড়ে অনেকে। খ্রিস্টান হয়ে যায়।’
বান্দরবানের ম্রলং পাড়ায় তার বাস। মেঘ খেলা করে ঘরের আঙ্গিনায়। আগে নওয়া পাড়ায় ছিল তাদের বসত । সেখান থেকে উঠে এসে এখানে ঘর তুলেছেন। সুয়া পা উ তাঁর মা। বয়স ৬৫। ঝিরি থেকে পানি নিয়ে উপরে উঠেছেন।
বললেন, ‘নিজের ভাষায় নিজের ধর্ম করি। ভাল লাগে। আমাদের বেশী চাওয়া নেই।’ অস্টম শ্রেণী পাস ইয়ং তাঁর একমাত্র ছেলে। বাবা মারা গেছেন। স্ত্রী ও মাকে নিয়ে ২৫ বছরের ইয়ং-’র সংসার। বান্দরবানে বাস করা দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী মুরং বা ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্য তাঁরা।
পাহাড়ে শান্তির জন্য মুরংরা সরকারকে সহায়তা করেছেন এক সময়। মুরংদের দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বাহিনী করা হয়েছিল। এটি মুরং বাহিনী বা লাল বাহিনী নামেই পরিচিত। ‘শান্তি’ চুক্তির পর অনেক সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতি হলেও মুরংদের উন্নতি হয়নি বলে দাবি ইয়ং এর।
বললেন, ‘আমরা আগের চেয়ে ভাল নেই। চিম্বুকের দিকে আঙ্গুল তুললেন। বললেন, সেখান থেকে মুরংদের কিছু পাড়া তুলে দিয়েছে। অধিগ্রহণ করা যাকে বলে। এখন ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। ক্ষতিপুরণের টাকা নিয়ে সবাই নিজের মত করে সরে আসছেন।’ এ নিয়ে মনোকষ্ট আছে মুরংদের।
এমনিতেই যাযাবর জাতি হিসাবে মুরং দের পরিচিতি। যেখানে জুম চাষের সুযোগ সেখানেই যান তাঁরা। তবে দশক তিনেকের মত তারা স্থায়ী আবাস গড়েছেন চিম্বুকে। সেখান থেকে তাদের তুলে দেবার চেষ্টা কনোভোইে সঙ্গত নয় বলে মনে করেন তাঁদের নেতা রাং লাই ম্রো। তিনি বলেন, ‘মুরংরা খুবই শান্তি প্রিয়। আমাদের নিয়ে এভাবে হয়রানি না করলেই ভাল। যাযাবর ছিলাম ঠিকই। এখন তো স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছি। এভাবে বারবার ঠিকানা বদলে ‘অতিষ্ট’ আমরা। আমাদের এখন নিজের মত করে থাকতে দেয়া উচিৎ।’
তিনি বলেন,‘ চিম্বুক থেকে থেকে মুরংরা উঠে এসেছেন তা নয়। বাঙালিদেরও তুলে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমাদের সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ সন্তোষজনক নয়।’
ক্ষতিপূরণ নিয়ে উঠে আসারা এখন পাহাড়ে তাদের বসত গড়ছেন। সেটি কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে তাং লাই ম্রং বলেন, ‘এখন সরকারি খাস জমি ছাড়া উপায় নেই। তাই আমরা পাশের যে যে পাহাড়ে জায়গা পেয়েছি । সেখানেই ঘর বেঁধেছি।’ অধিগ্রহণের মধ্যে পড়া পাড়ার সংখ্যা প্রায় সতেরোটি বলে রাং লাই জানিয়েছেন।
ক্র্যামা ধর্মে বিশ্বাস রাখা মুরংরা ১৯৭৫ সাল থকে যাযাবর জীবন বদলেছেন। সংখ্যায় তাঁরা ৫৯ হাজার ছিলেন বলে জানান রাং লাই। তবে এদের বেশীর ভাগই এখন ক্র্যামা ধর্মে বিশ্বাস করেন। মুরংদের নিজস্ব বর্ণমালায় ধর্মের কথা লিখেছেন ম্যান লে। সে সব বর্ণমালা ও উপদেশ বুঝতে সুবিধা বলে এ ধর্মের প্রতি তাদের অনুরাগ। তবে কেউ কেউ এ ধর্ম বদলে খ্রিস্টান হচ্ছেন। এ রকম আরো অনেকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন। এর মধ্যে মারমা ও খিয়ারা এগিয়ে।
বোম সম্প্রদায়ের পুরোটায় খ্রিস্টান। সংগঠিত। গেৎসিমণিপাড়ায় চা খেতে খেতে এক দোকানির সাথে আলাপে জানা গেলো গেৎসিমণিপাড়া নামকরণের কথা। বললেন, এটি নাম করণ হয়েছে এ কারণে যে, যিশু কে ক্রুশ বিদ্ধ করার আগের উদ্যান ছিল গেৎসিমণি। এখানে প্রার্থনা হয়েছিল। কেবল ধর্মীয় পরিচয় নয়; ধর্ম সম্পর্কে ভাল খোঁজ খবর আছে তাঁর- সহজেই এটি বোঝা গেলো। তবে খিয়াংদের মধ্যে এখনো বৌদ্ধ ধর্ম এগিয়ে আছে বলে রনি খিযাং জানিয়েছেন।
খ্রিস্টান ধর্ম ২০১৭ সালে পাহাড়ে শতবর্ষ উদযাপন করবে বলে বোমরা জানিয়েছেন। মানিক বোম জানান, এটি ১৯১৭ যাত্রা করে এখানে।
ধর্মের এ বদল সম্পর্কে বান্দরবানের বোমাং সার্কেল রাজা অং শৈ প্রু বলেন, ‘অনেকের আসল কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃতি পূজা করত। তারা বিভিন্ন ধর্মে চলে যাচ্ছেন। আবার খ্রিস্টান হলে তো লাভই। একটু স্বচ্ছন্দে চলতে পারেন। একটু সুবিধা মিলে।’ ‘সুবিধা’র জন্য খ্রিস্টান হওয়া আর ধর্ম পালনের জন্য হওয়ার মধ্যে বেশ তফাৎ দেখতে পান পুং খাল বম। তিনি বলেন, আমরা মনে প্রাণে ধর্ম পালন করি।
কেবল ধর্মের বিষয় নয় মুরং হারিয়েছে তাদের ঐতিহ্য। তাদের ছেলে মেয়েরা আগে ঐতিহ্যবাহি পোশাক পরলেও এখন সেখান থেকে সরে যাচ্ছেন। রাং লাই বললেন, ‘ক’ দিন পর মুরংদের পোশাক আমার ড্রয়িং রুমে লাগাতে হবে। অবস্থা এমনই হচ্ছে।’ তবে রাজা বললেন, ‘রোমে গেলো রোম হয়ে যেতে হয়। তাই এখানে বাঙাগালির প্রভাব পড়বেই। এটাকে অস্বীকার করলে চলবে না।’
তিনি বলেন, ‘এটি কেবল মুরংদের ক্ষেত্রে নয় অন্যসব জাতি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’
‘শান্তি’ চুক্তি পর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি মুরং দের। বিকালের বৃষ্টির ভেতর রেনিক্ষং বাগান পাড়ার বাসিন্দা ম্যান লং ম্রো বললেন, আমাদের ছেলে মেয়েরা সরকারি কোটা পাচ্ছে না। কারণ হলো এখানে শিক্ষার সুযোগ নেই। আবাসিক স্কুল বলতে দুটি। এনজিও স্কুল আছে কিছু। এখন অবশ্য অবস্থার খানিকটা উন্নতি হচ্ছে। তবে সেটি উল্লেখ করার মত নয়।
তিনি বলেন, ‘কোটা কাদের জন্য ? যারা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য তো। কিন্তু আমরা এটি সেভাবে পাই না।’ তার সাথে একমত হয়ে রাং লাই বললেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোটা আছে সেটি চাকমারা পেয়ে যায়। আমাদের ছেলে মেয়েরা পায় না। কারণ হলো চাকমারা এগিয়ে আছে। আমরা একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে দেখা করে বলেছিলাম কোটা আপনারা ‘আদিবাসী’দের মধ্যে পিছিয়ে পড়াদের জন্য দিন। অথবা তাদের জন্য কোটার ভেতর থেকে আলাদাভাবে কোটা করে দিন। কিন্তু সেটি তাঁরা করেননি।’
মুরং যুবক রিং লট বলেন, ‘আমাদের এগিয়ে নেবার মত কিছুই করা হয়নি। বাঁশ চিরে বিশেষভাবে বানানো রেজর দিয়ে দাঁড়ি কাটছিলেন তিনি। বললেন, ‘সেভ করতে সপ্তাহে ৫ টি ব্লেড কিনলে দশ টাকা খরচ। তাই এ পদ্ধতি। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। জুম চাষ করি। তা দিয়েই চলে।’
রেনি ক্ষং পাড়ার ম্যান লং এক সময় মুরং বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। এখন অবসরে। বললেন, ‘শান্তি বাহিনীর সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। সাঙ্গু ও রুমাতে যুদ্ধ হয়েছে। ৬ শ টাকা মাসিক বেতন ভাতা পেতাম। সাথে রেশন। সৈন্যরা পেতেন ৪৫০ টাকা। এখনো আছে। তবে একটা সময় কাজ ছিল যুদ্ধ করা। এখন আমাদের মুরং বাহিনী দিয়ে ঘাস কাটানো হয়।’
আগে ৬ হাজারের মত মুরং বাহিনী থাকলেও এখন আছে সাকুল্যে তেরশর মত। ম্যান লং বললেন, আমরা বৈষম্যের শিকার। আমাদের দিকে সেভাবে কারো নজর নেই। তিনি বলেন, আমরা ‘শান্তি’ বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেছি পাহাড়ে শান্তির জন্য। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। অবস্থার এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে মুরংদের প্রাপ্ত সম্মান এখনো পাইনি। যারা ‘সন্ত্রাস’ করেছে তারা সম্মানিত হয়েছে। তাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় আফসোস তাঁর। আগামী প্রজন্মের মুরং-রা যেন সম্মান পান সে আশা করে ম্যান লং। বললেন, আমাদের ছেলে মেয়েরা শিক্ষত হোক। তাদের এগিয়ে নেবার জন্য সরকার হাত বাড়িয়ে দিক।
তাদের নেতা রাং লাই ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে তাঁর বান্দরবানের বাসায় বলেছেন, পাহাড়ে কোনো অশান্তি থাকত না যদি না রাজনীতিকরা এটা নিয়ে রাজনীতি না করতেন। তিনি বলেন, সেনা মুরং পাড়া থেকে তুলে নেবার দরকার হলেও সরকার এখান থেকে তুলছে না। যেখান থেকে তুলছে সেখানটায় সন্ত্রাসীরা থাকেন। মুরংরা ‘সন্ত্রাস’ করে না;‘ হুমকি’ দেয় না। সে জন্য এখানে এখানো সেনা উপস্থিতি থাকছে। তবে তাদের থাকা না থাকায় আমাদের কিছু যায় আসে না। ##
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন