ওরা ১১ জন কিম্বা জীবন যেখানে যেমনের মত সিনামা দিয়ে স্বাধীনতা উত্তরকালে যে বঙ্গ সিনামার উত্থান,সে সিনামা ব্যবসা হারাতে শুরু করলো এবং এখন দেউলিয়া আখ্যা দিয়া হল ঘরে জলসা জমাতে উর্দু-হিন্দি সিনামার দ্বারস্থ হতে হলো; সেটা কিন্তু একদিনে হয়নি।
ব্যাক্তিগতভাবে আমার সিনামা দেখার অভিজ্ঞতা 'গরম হাওয়া' দিয়ে। এটা সম্ভবত ১৯৯৩ সালের ঘটনা। সিনামায় নকল, অবিকল কিম্বা সেমিনকল হবার ঘটনা পুরনো; সে ক্ষেত্রে বাংলা সিনামা এ দোষে যুক্ত; এটা নিয়ে দ্বিমত নেই।
কিন্তু এ নকল বা অনুকরণ করাকে একটা বাড়াবাড়ি রকমের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি আসলেই অগ্রহণযোগ্য ছিল। এর কারণ কি ছিল তা নিয়ে অনেক মত রয়েছে। তবে একটা দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে বঙ্গ সিনামা হাল খ্রাপ হতে হতে এখন আর বলার মত কিছু নাই বলে কারো কারো দাবি-এ দাবির সাথে আমি একমত মত নই।
এখানে সিনামায় অশ্লীলতার গল্পটা বলতেই লিখছি-
বাংলাদেশের মত একটি অতি উদার-রক্ষণশীল সমাজে ইউভার্সেলই একমাত্র সেন্সর রেটিং। এর বাইরে আর কোনো রেটিংয়ে সিনামা মুক্তি পায় না।
সত্তুরের দশকের শেষের দিকে 'গোপন কথা' নামে যে সিনামাটি এডাল্ট রেটিং দাবি করেছিল এটি হাল আমলে যে কোনো সুশীল সিনামার চেয়েও সুশীলতর বলে ২০০৬ সালের দিকে সেন্সর বোর্ডে গল্পচ্ছলে একজন সদস্য জানিয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের দিকে বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতার মহামারি আকারে আসে। এ সময় সিনামায় এতটা অশ্লীলতা প্রবণ হয়ে ওঠে যে মোহাম্মদ হোসেন পরিচালিত ‘ফায়ার’ সিনেমাটি এডাল্ট রেটিংয়ের সেন্সর সনদের আবেদন করেছিল। তবে এটি তারা পায়নি।
এ সিনামায় নায়িকা পলির শরীর দেখানোর কসরতে কোনো রকমের কমতি ছিলনা মোহাম্মদ হোসেনের।
থাইল্যান্ডে এর শুটিং হয়েছিল এবং তাতে থাই নাইট ক্লাব সংস্কৃতির চিত্রও তুলে ধরেন হোসেন।
১৯৯৭ সালের দিকে বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতার পরিমাণ আরো বাড়ে। সে সাথে ভারতীয় নায়িকাদের এনেও এতে ভিন্ন মাত্রা দেবার চেষ্টা করা হয়।
মোহাম্মদ হোসেন ভারতের নায়িকা ঋতুপর্ণাকে দিয়ে নিমাণ করেন ‘রাঙাবউ’ সিনেমাটি। এতে সিনেমাতে বেশ কিছু অশ্লীল দৃশ্য ছিল।
এরপর সে সময়কার সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান কবি রবীন্দ্র গোপের সহায়তায় অশ্লীলতার বিস্তার ঘটতে থাকে। তার উপন্যাস থেকে সিনামা বানানোর ঘোষণা দিয়ে এয়াতে করিম বেশ কয়েকটা অশ্লীল সিনামায় বানিয়ে সেন্সর সনদ নিয়ে যান।
ডিপজল, দীপু, আজাদ খানের মত আরো বহু লোকজন অশ্লীল বাংলা সিনেমা তৈরী বানাতে থাকেন। এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ‘ভয়াবহ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। ওই সিনেমায় এক সাথে চারটি ধর্ষণ দৃশ্য সংযুক্ত করা হয়। এরপর বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতা বন্ধ করা যায়নি। এটি দিনের পর দিন বাড়তে থাকে, সে সাথে অশ্লীলতার মাত্রা এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, মধ্য বিত্ত হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন।
নায়িকাদের পোশাক ছোট হতে হতে এবং বেড সিন যোগ হতে হতে সেটি বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে ওঠে। শেষে দেখানোর আর কিছু থকে না,ম বাথরুম, সুইমংপুল হয়ে সিনামার শরীর দেখানোটা তুঙ্গে ওঠে। গল্পের বদলে চলে আসে শরীর-বৃত্তি।
২০০১ সালের সরকারে পরিবর্তন, ১/১১এর প তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও একই হাল ছিল।
‘মহিলা হোস্টেল’, ‘মডেল গার্ল’ ও ‘নষ্টা মেয়ে’র মত সিনেমা নিয়ে যখন তুমুল সমালোচনা হচ্ছিল, সে সময় এ সব সিনেমার সাময়িক লাগাম টেনে ধরার জন্য সেন্সর সনদ সাময়িকভাবে বাতিল করে।
নির্মাতারা পরে আবার আদালত থেকে ছাড়পত্র নিয়ে সিনেমাগুলো ছাড় করতে শুরু করেন।
২০১০ সালে এসে সিনামায় কাটপিসের সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যায়। আগে সিনামায় কাটপিস থাকতো চার ৫ টি। কিম্বা ৫ থেকে ১০ মিনিট। এবার সেটি ৪০ থেকে ১ ঘন্টা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
এ রকম পরিস্থিতিতেও দেশে ভালো সিনামা হয়েছে। গেরিলা, ব্যাচেলর, সার্চ দ্যা খোঁজ, কাবুলিঅলা, আমার আছে জল কিম্বা ঘেটুপুত্র কমলাকে কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন ? পারেন না।
বাংলাদেশের সিনেমার এমন দুর্দিনকে সামনে রেখে ভারতের সিনেমা আমদানি করা হচ্ছে এমন কথা বলছেন প্রদর্শকরা। তারা এও বলছেন, সিনেমাহল বাঁচাতে হলো ভালো সিনেমা লাগবে, যেটি বাংলাদেশে হচ্ছে না।
২০১১ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে আসে বাংলা সিনেমা ‘জোর, ‘বদলা’ ও ‘সংগ্রাম’। চলতি মাসে মুক্তি পেলো ওয়ানটেড।
সিনামা হল অলারা বলছেন এ দেমে ভালো সিনামা হয় না, নাই তাই আমদানি করে হল বাঁচাইতে চাই। কিন্তু তা কি ঠিক?
কাটপিস দেখানোর গুরু হলো ঢাকার বাইরের হলগুলো। আামরা প্রথম কাটপিস দেখেছিলাম আদমজীনগরের মুনলাইট সিনামা হলে। হঠাৎ করে কাটপিস এসে পড়ায় বন্ধুরা সবাই বিব্রত। এরপর মুনলাইট সিনামা হল এ ভিড়; মেরেও লোক সরানো যায় না। একই রকম অবস্থা ছির বন্ধু, লাভলী, রাজমহল সিনামা হলেও। ঢাকার বাইরে এমন কোনো হল ছিল না যেখানে কাটপিস দেখানো হতো না।
এ সব কাটপিস মিলতো গুলিস্তান মার্কেটে। সিনামার রোলের সাথে এ সব কাপিট কিনে নিতেন হল মালিকরা। প্রশা্সনকে ম্যানেজ করেই পরিবেশন করতেন এ সব। এ নিয়ে প্রতিবাদও হয়েছিল। নায়িকা ববিতা এর প্রতিবাদ করে সেন্সর বোর্ড ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তাকে খ্রাপ ভাষায় গালিগালাজ করেছিল নির্মাতারা।
তবে স্রোতে গা না ভাসিয়ে অনেকেই ভালো সিনামা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। তাতে হল মালিকরা জুড়ে দিয়েছিলেন অশ্লীল দৃশ্য। যেমন ধরুণ খায়রুন সুন্দরী সিনামার কথা। নায়িকা মৌসুমীর এ সিনামাতেও কাটপিস জুড়েছিল নারায়ণগঞ্জের হীরা সিনামা হল।
বহু হলে গিয়ে দেখেছি সিনামার অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম ধামে বা পরিচালকের নাম ধাম নাই আছে অচেনা মেয়েদের গা গোলা ছবি। এ সব প্রিন্টও হতো ঢাকায়। সরবরাহ হতো হলে এবং এভাবেই হল মালিকরা অসাধু পরিবেশকদের সহায়তা টেনে নামালেন বাংলা সিনামা। এখন বললেন হল টিকাতে হিন্দি সিনামা লাগবে। আহা কি দারুণ খেলা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন