সুখ অসুখের গল্প : ৪:: নিজামউদ্দিন আউলিয়া আর মির্যা গালিবের মাজারে একদিন।




সুখ অসুখের গল্প : ৪:: নিজামউদ্দিন আউলিয়া আর মির্যা গালিবের মাজারে একদিন।

ডাক্তারের কাছ থেকে 'অপারেশন লাগবে না'- সিদ্ধান্তের পর  হাতে অনেকটা সময় পাওয়া গেলো। এ সময়টা আব্বার তার শিক্ষাজীবনের প্রিয় কিছু নায়কের কবর জিয়ারতে যেতে চান। আমাকে এমনটা্ই বললেন।

আমি দিল্লি বেশ কয়েকবার আসলেও দিল্লি জামে মসজিদ আর কারিম'স রেস্টুরেন্ট ছাড়া অন্য  ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাওয়া হয়নি। তাই চিনতে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো।

দিল্লি এপোলোর পেশেন্ট লাউঞ্জের পশ্চিম মাথায় একটা  নামাজের জায়গা আছে। সেখানকার ইমামকে আব্বা খুঁজে বের করলেন।  তাঁর কাছেই তিনি শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী, মির্যা গালিব আর  নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি সম্পর্কে  জানতে চান? এমন প্রশ্ন করতে ইমাম সাহেব কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। পরে আব্বার পরিচয় জানতে পেরে তিনি  সব কিছুর সঠিক ঠিকানা সংগ্রহ করে দিলেন।

প্রথম দিন ১৬ জুন, আব্বার ফিজিওথেরাপি শেষ করে ইমাম সাহেবের  ঠিক করে দেওয়া  টেক্সি করে গেলাম নিজাম উদ্দিন  রহ: এর সমাধি ও খিলজি মসজিদে। সারিতা বিহার থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। গাড়ি থেকে নেমে অনেক দূর হেঁটে আমরা পৌছালাম  নিজামউদ্দিন আউলিয়ার  সমাধিতে!

পথে পথে মাজারে দেয়ার জন্য ফুল, ক্যালিগ্রাফি সমেত সবুজ কাপড় আর লোবান-মোমবাতি বিক্রি হচ্ছিলো। যেমনটা হিন্দি সিনামায় দেখা মেলে।  বহু পুণ্যার্খী সেখানে এসেছেন। ধর্ম-বর্ণ-বিচার নেই।

আব্বার সাথে যাওয়ার পর আমার গাইডের দরকার পড়লো না। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মা'রেফাতের  বিষয়ে বিস্তারিত শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, এটা জেনে যে, আধ্যাত্মিক শক্তিও  মোগল সম্রাজের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

ভেতরে ঢুকলে  মানুষের কিছু আচরণকে যে কারো  খারাপ লাগবে। আব্বা বিরক্তি প্রকাশ করছেন।  কিন্তু এটা তো সত্য যে, এখানে আমাদের কিছু করণীয় নেই।

 তার মতে, এখানে যারা পুণার্থী তাঁদের প্রায় সবাই ধর্ম অবমাননা করছেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়ারা যে জন্য ধর্ম ও মুসলামনের সম্রাজ্য বিস্তারে পরিশ্রম করেছেন, তারা তার বিপরীতে চলছেন।

তবে এটাও সত্য যে নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে  বঙ্গীয় মাজারের মত সিজদায় পড়ে থাকার সুযোগ নেই।  নামাজ পড়ার জন্য  মো্গল আমলের খিলজি মসজিদ আছে।

নিজাম উদ্দিন আ্উলিয়ার  মাজারের  পুরো আঙ্গিনা আমরা ঘুরে দেখলাম,  খিলজি মসজিদেও যাওয়া হলো। মোগল আমলে অন্য সব মসজিদের মতই লাল ইটের গাঁথুনি অনন্য এক মসজিদ। অসাধারণ স্থাপত্য নকশা যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

 সমাধিতে ফুল আর সবুজ কাপড় বিছানো এখানে যেন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। আমাদের খালি হাত আর  ঘুরতে দেখে অনেকে বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকাচ্ছেন।

 নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার সমাধি জিয়ারতের পর আমরা বেরিয়ে আসলাম।

 বাইরে প্রচণ্ড রোদ্দুর। গেটের বাইরে আসতে তাবলীগ জমাতের মারকাজ।  তার একটু আগেই মির্যা গালিব একাডেমি। আব্বার চোখ পড়তেই এগিয়ে গেলেন। গালিবের   সমাধি কোথায়? জানতে চাইতে দেখিয়ে দিলেন, সেখানকার একজন ।  সমাধধি প্রাসঙ্গে উন্মুক্ত মঞ্চ। মঞ্চের সামনে খোলা মাঠ। সেখানে কিশোররা ক্রিকেট খেলছে।  তাদের  কাছ থেকে  সমাধির ঠিকানা জানতে চাইলে  তারা সিকিউরিটি গার্ডকে দেখিয়ে দিল। গার্ড তালা খুলে আমাদের নিয়ে গেলেন সমাধিতে।

 আব্বা বলছিলেন,  মির্যা গালিব  কেবল মুসলিম জাগরণের কবিই নন, তিনি একজন দার্শনিকও। তার বহু কবিতা আব্বা জানেন। সেখান থেকেও কিছু কবিতার পটভূমি আমাকে জানালেন। এটা একেবারেই আমার প্রথমবার জানা।

 আব্বা কিছুটা আক্ষেপ করেই বললেন, মির্যা গালিব সম্পর্কে আমাদের অনেকেই জানেন না। আর আমরা যেহেতু উর্দু জানি না, তাই মির্যা গালিবের কবিতা বোঝা মুশকিল।

 আমি ব্যক্তিগতভাবে  ভূপেন হাজারিকার গান 'আমি এক যাযাবর' এ প্রথম মির্যা গালিবের  নাম শুনেছি। এ টুকুই!

 মির্যা গালিবের মাজার  এলাকা খুবই সুরক্ষিত এবং পরিচ্ছন্ন। আব্বা  মির্যা গালিবের  সমাধি জেয়ারত করলেন।  বললেন, জীবনে আর কখনো হয়ত আসা হবে না। তাই  দেখে  গেলাম।

আমরা বেরিয়ে আসছি।   পরে গালিব একাডেমি থেকে আব্বা একটা কবিতা সঙ্কলন কিনলেন।  স্মৃতি হিসাবে সংরক্ষিত থাকরেব। কারণ আব্বা ছাড়া আমরা কেউ উর্দু পড়তে পারি না! সুতরাং এটি স্মৃতিতে চলে যাবে!। তবে গালিবের কিছু কবিতা ইংরেজি ভাষায় রয়েছে।  এর একটা সংকলন  পাওয়া যাবে। সেটি থেকে কিছু কবিতা পাঠ করার চেষ্টা করছি।

 একটি অনন্য অভিজ্ঞতা আর অসাধারণ  দিন কাটলো আমাদের। আব্বা মাজার ও মাজার ঘিরে মানুষের যে সব  কর্মকাণ্ড এ সবের প্রচণ্ড বিরোধী হবার কারণে, একজন পর্যটনকর্মী হিসাবেও আমি যখনই যে নগরে গেছি খুব বিখ্যাত কোন মাজার না হলে সেখানে আমরা যাওয়া হয়নি।

তবে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের যাবার পর মনে হযেছে, সব মাজারে যাওয়া উচিৎ এবং এখানেও মানুষের আচরণ -অসহায়ত্ব দেখার একটা সুযোগ আছে।   যেহেতু আমি মানুষ  ও তাদের আচরণ  দেখতে পছন্দ করি এবং সেটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকি,তাই এ সব জায়গায় না যাওয়াটা আমার একটা ভুল ছিল।

কেউ কেউ মাজারে যাওয়াকে শিরক মনে করেন।  অন্য শিরক করছে, আপনি বা আমি যাচ্ছি কেন?  আমি ব্যক্তিগতভাবে  মাজারে যাওয়ার বিরোধি নই। এবং ছোট ভাই হিরো আমাকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের পর আমি যে টুকু পড়েছি, তাতে মা্জারে যেতে বাধা আছে এমন কোন তথ্য ধর্মীয় বিধি নিষেধ পাইনি। বরং আমার মনে হয়েছে, আমরা এ সব জায়গা এড়িযে যাবার কারণে, কিছু ভণ্ড, ধান্ধাবাজ আর ভয়ঙ্কর রকমের অপরাধীরা মাজারকে তাদের দখলে নিয়ে অপকর্ম করছে। এ সব অপকর্ম থেকে মনিষীদের মাজারকে মুক্ত করার জন্য আমাদের মাজার পূজারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।

 আর এটা তো সত্য মৃত ব্যক্তি  অসহায়। তাঁর কারো জন্য কিছু করার থাকে না। 

কোন মন্তব্য নেই: