সুখ অসুখের গল্প-৬: ডাক্তার বাবু বনাম স্যার!


বঙ্গে ডাক্তার মহোদয়কে 'স্যার' 'স্যার' বলে ফেনা তোলার পরেও তাঁদের দিলে হয় না।  তবুও রোগী বলে কথা, মানুষ্য যন্ত্রের বিকলতা সারাতে আমরা সরাই কারখানায় যাই। ডাক্তার মহোদয়রা যা ইচ্ছা তা বলে বিদায় করেন, অনেকটা পুরনো জমিদারি আমলের মত, যাও বাবা যাও!  এত কথা বলো কেন, ৫/৭ শ টাকা গুণে এত (!)  বলাটা  যেন, অপরাধ!

তাই আমরা রোগীরাও কাঁচুমাচু করে ফিরে আসি। আসার পর মনে হয়, আমার তো আরেকটা সমস্যা ছিল বলা হয়নি! বলা হবে কেমনে, ডাক্তার স্যার যেভাবে দ্রুততার সাথে রোগীর মনের  সব খবর 'কপি' করে নিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে ফেলেছেন, তাতে আমার মনে হয়েও বা লাভ কি?

ইনডিয়াতে এসে দেখলাম, ব্যতিক্রম। টাকাটা উনারা হালাল করে নেন। বের হবার আগেও আবার জিগেশ করেন, 'স্যার' আর কিছু বলবেন! বলতে পারেন।  আমি শুনতে চাই। এত দূর থেকে এসেছেন, বলুন না।

বিস্মিত হবার কারণ নেই, ডাক্তার সাহেব রোগীকে স্যারই বলবেন, এটাই কর্পোরেট হসপিটালের নিয়ম।
তো বঙ্গেও করপোরেট হসপিটাল আছে? ইনডিয়া্নরা ত এখানেও আসেন, কই তা তো বলেন না!  বঙ্গে আসলে সবাই তো সে জমিদারি পেয়ে বসেন জনাব!  তাই হয় ত তারা রোগীকে সম্মান করতে চান না!

আব্বাকে নিয়ে ডাক্তার অমিত মিত্তালের চেম্বারের সামনে বসে আছি।  তার প্রাইভেট সেক্রেটারি এগিয়ে বললেন, স্যার আসুন। আমরা একটু ইতস্তত করে জিগেশ করলাম, আমাদের বলছেন? ভদ্রলোক আরেকটু বিনয়ের সাথে বললেন, 'ইয়েস স্যার'!

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার মিত্তাল উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে মোলাকাত করলেন।  চেয়ারটা টেনে দিয়ে বললেণন, প্লিস বসুন।
 আব্বা এবং আমি বসলাম।

 আব্বার কাছে প্রথমেই জানতে চাইলেন, কখন এসেছেন। এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
আব্বা বলছেন, তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন।  উর্দুতেই বাৎচিৎ চলছে। টেস্ট দিলেন। সাথে সাথে করার ব্যবস্থাও করে দিলেন। কিউটা একটু বেশি, তাই ক্ষমা চাইলেন, কয়েকবার।

রিপোর্ট দেখার জন্য ডাক্তার মিত্তাল অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু তার নির্ধারিত চেম্বারের সময়েরও  পরেও তা হয়নি।  উনি আগামীকাল রিপোর্ট দেখবেন বলে জানালেন। যাওয়ার সময় নিজে এসে ওয়েটিং রুমে বলে গেলেন, আমরা যেন তার সিনিয়র ডাক্তার মোহন্তীকে একবার দেখিয়ে যাই।

 রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বিকাল তিনটার দিকে ডাক্তার মোহন্তীর  রুমে ঢুকতেই ডাক্তার হেসে বললেন, আসুন প্লিজ। বসুন।  রিপোর্ট দেখলেন। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে, বাংলায় কথা বলছেন মোহন্তী। চেন্নাইয়ের সিএমসিতে হার্টের অধ্যাপক ছিলেন। এখন এপোলোর হার্ট সেন্টারের প্রধান।  রিপোর্ট দেখে, তিনি আব্বাকে তার সমস্যা নেই বলে জানালেন।  সমস্যা নেই, এটি তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, সেটিও ব্রিফ করলেন।

 ওষুধ লিখে বললেন, আপনি দিন কয়েক খেয়ে ওষুধ ম্যাচ হয়েছে কিনা আমাকে জানিয়ে যাবেন। ওঠার পর মোহন্তী  তার চেম্বারের দরজা পর্যন্ত আব্বাকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, বহু লোকের উচ্চ রক্তচাপ আছে! কিন্তু এর কারণ নির্ণয় হয়নি, তাই আমরা এটাকে বংশগত বলে আপনাদের  বলি!

 একদিন পর আব্বা বলছেন, রিপোর্ট করতে দিয়েছে, ডাক্তার মিত্তাল। তাকে একবার দেখানোে গেলে ভালো হতো। আমি  ইন্টারন্যাশনাল পেশেন্ট লাউঞ্জে  সুনিতাকে  বললে, সে হেসে বলল, আপনি যত বার ইচ্ছা দেখাতে পারেন। এ জন্য কোন ফিও লাগবে না।

 মিত্তালের চেম্বারে  বসে আছি। তিনি  রাউন্ডে গেছেন। তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি জানালেন, ডাক্তার আসতে মিনিট ১৫ সময় লাগবে। আমরা জোহরের নামাজ পড়ে এসে দেখলাম, ডাক্তার অপেক্ষা করছেন। রিপোর্ট দেখে তিনি ডাক্তার মোহন্তীর লেখা একটা ওষুধ বাদ দিলেন।

 বললেন, ঠিক হয়ে যাবে! প্রেসারের ওষুধ সব সময় খেতে হবে। আর কোলেস্টরের ওষুধ তিন মাস। বঙ্গের ডাক্তারের দেয়া  কোলেস্টরের কয়েক বছর ধরে  জারি রেখা ওষুধ  বদলে দিলেন। বললেন, ওষুধ খেতে নেই। যত পারেন , কম ওষুধ খান।  ওষুধ কম খেলে বেশি দিন বাঁচবেন।

 আব্বার প্রেসার চেক করতে চান।  মিত্তাল উঠে এসে প্রেসার মাপলেন। বললেন, আপনি ভালো আছেন।
 ওষুধ এবং  দেশে আসার পর আমাদের করণীয়ও ঠিক করে দিলেন তিনি। বললেন, সমস্যা হলে যেন তাঁকে মেইল করি।  তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলফোন নম্বর এবং ই মেইল আইডি দিলেন।

 উঠে আসার সময় বললেন,  টেনশন নিবেন না। সুস্থ্য হয়ে যাবেন।

 ফেরার দিন ডাক্তার মোহন্তী হোম প্ল্যান করে দিলেন। বলে দিলেন, মিত্তাল অথবা তাঁকে যেন সমস্যা হলেই জানানো হয়। ব্যস্ততার ভেতর ফোন ধরবেন কি না, সেটাও জানতে চাইলেন আব্বা। বললেন, স্যার রোগীর সেবা করাটাই আমার কাজ। ফোন ধরবো!


 দু'জন ডাক্তারকে ৪ বাজার দেখালাম, সাকুল্যে ১০০০ রুপি ভিসিট দিলাম!

আব্বার মূল সমস্যা ছিল স্পাইনের।  এর জণ্য ডাক্তার সুধীর তিয়াগি  দেখলেন। আব্বার  বস বলছিলেন , আমরা যেন ভিপি সিংয়ের দপ্তরেও একবার যাই। ভিপি সিংও নিউরো এন্ড স্পাইন সার্জন।

 রিপোর্ট দেখলেন। সুধীর বাবুর প্রেসক্রিপশনও দেখলেন।  কোনো রকমের পাণ্ডিত্য না ফলিয়ে বললেন,  সুধীর বাবুর ট্রিটমেন্টই চলবে।

 তবে এ রোগের জন্য ওষুধের চে ব্যায়মা্টা খুব কাজে দিবে। সেটিও  বললেন।

ভাবছিলাম, সুধীর বাবুকে দেখোনো অপরাধ হিসাবে গণ্য করবেন  মিস্টার ভিপি সিং। বরং উল্টো !  অথচ এপ্রিল মাসে আমার ছোট বোনের শাশুড়িকে স্কয়ারে  রেসপেরেটরি মেডিসিনের ডাক্তার দেখানোর পর  ময়মনসিং মেডিকেলের মেডিসিনের প্রধান ডাক্তার জহির চেম্বার গেলে' কুত্তার' মত 'ঘেউ' করে ওঠে। 'শুয়র'টা থাপড়াইতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বোনের শাশুড়ি সামনে বলে সামলে এসেছি।

এখানকার ডাক্তার সহনশীলতা দেখে মনে হলো, কেন ১২১ টি দেশ থেকে এপেলোতে এত রোগী আসে। আর আমাদের দেশ থেকে আমরা কেন  অপমান সয়ে ভিসা  নিয়ে ইনডিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে যেতে বাধ্য হই! 

কোন মন্তব্য নেই: