কার্টুন: প্রথম আলো
বিষয়টি খুবই পরিষ্কার- ডাক্তার কারো শত্রু নয়। আবার মিত্রও নয়। অন্য দশটা পেশার মতই তারা টাকা নেন, সেবা দেন। এখানে পার্থক্য হলো- তারা মানব শরীর নিয়ে কাজ করেন। যেটি একবার 'মৃত' হলে ফেরৎ আনা যায় না। তাই সংবেদনশীল এ শরীর ঘিরে যারা নিজেদের জীবিকা নিশ্চিত করেন, তাদের 'দায়' থাকে কাজটি পেশাদারিত্বের সঙ্গে করার।
পেশাদারিত্ব মানে নথিতে পেশা- চিকিৎসক লেখা নয়।
চিকিৎসকরা এতটাই ব্যস্ত থাকেন এবং নিজেদের এমনই লোক মনে করেন যে, তারা যাচ্ছে তাই আচরণ করেন। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এবং ব্যতিক্রম চিকিৎসকের দপ্তরে যাওয়ার আমি নিজেও মাসের পর মাস অপেক্ষা করি অথবা অনেক বেশি টাকা গুনি। কারণ পেশাদার ডাক্তারকে আমার লাগবে। আমি একজন ভোক্তা হিসাবে সেটিই চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবন কাটিয়েছি। সেখানে কিছু ষণ্ডা টাইপ পলিটিক্যাল পোলাপাইন থাকে। নিজেরে ওরা মনে করে, ওর উপ্রে আর কেউ নাই। ধরাকে সরা জ্ঞান করা যাকে বলে আরকি। একই রকম ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও (কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন)। তাদের মাস্তানি অপ্রতিরোধ্য। তারা যদি ভুল করেন, তা তদন্ত করা যাবে না। তাহলে তারা মগজে গিঁট মেরে বসে থাকবেন। তাদের তেল দিবেন, সরকার নমনীয় হবেন, মানুষ বলবে, নাহ আপনি তো সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচটন , তাই আপনি আমাগো ক্ষমা করেন। চিকিৎসা কাজে ফিরে আসেন।
সর্বশেষ নজির হলো সেন্ট্রাল হসপিটাল। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন। এটা হয়েছে, এটাই সত্য। এর জন্য ন্যুনতম 'দায়বদ্ধ'তা থাকলে হসপিটাল একটা তদন্ত কমিটি করতো। না, তারা তা করেনি। উল্টো-' আমরা কোন ভুল করিনি, যা করেছি বেশ করেছি। তুমি কি ডাক্তার! তুমি কোন ...টা বোঝ। এ ধরণের আচরণ-!' -এ সব অগ্রহণযোগ্য।
তদন্ত করেন, আপনারা ডাক্তাররাই বসেন, বসে বলেন, এটা সঠিক ছিল। তাহলে পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে হয় না। প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে হাসপাতাল, ক্লিনিকে বহুলোক মারা যা্য়। এর কোন তদন্ত হয় না।
মিডিয়া নিয়ে অনেক ডাক্তার সাবের কষ্ট দেখছি- ' এ যে উনারা বিখ্যাত, উনারা ফেরেশতা , উনারা জাতিকে উদ্ধার করছেন- এ সব খবর ছাপানোর জন্য উনারাই মিডিয়ার কাছে আসেন। কী বৈপরিত্য উনাদের।'
বলছিনা, ডাক্তার মাত্রই খারাপ। কিন্তু ডাক্তার মাত্রেরই সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা প্রায় জিরো। রোগীর বক্তব্য শোনার আগ্রহ নেই বললেই চলে। মনে করিয়ে দেই, কিছু ব্যতিক্রম আছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রালের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, এর সিদ্ধান্ত আদালতে নিতে দেন। অনেক ডাক্তারকে দেখছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন করছেন। করতে পারেন, এটা আপনার নাগরিক অধিকার।
কিন্তু মেডিকেল কলেজের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আপনাদের মধ্যেই আছে। আপনারা ডিমএসি, এসএমসি'র বাইরে অন্য কলেজের ডাক্তারদের সেভাবে কাছে টানেন না। যেভাবে নিজেরা নিজেদের টানেন।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে যারা প্রশ্ন করছেন, তারা কিন্তু ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের অধিভূক্ত মেডিকেল কলেজেরই শিক্ষার্থী।
আপনি যদি মনে করেন এ বিশ্ববিদ্যালয় খারাপ, তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ ফেরৎ দিন।
সরকারকে বলেন, মেডিকেল কাউন্সিল করে আপনাকে সনদ দিতে। সরকার দেবে, নিশ্চিতভাবে দেবে। কারণ এ দেশে মানুষের জীবন জিম্মি করে একামাত্র আপনারাই মগজে গিঁট মেরে চা -সিগ্রেট ফুঁকতে পারেন! বহু হসপিটালে আপনারা তা করে দেখিয়েছেন, আপনাদের ধর্মঘটের কারণে বহু রোগীর ভোগান্তি হয়েছে।
তবে একটা কথা বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে বলে- আপনারা এই যে চিকিৎসার নামে সন্ত্রাস করছেন, মানুষ মারছেন, মানুষকে স্যার বলতে বাধ্য করতে পারছেন এটা সম্ভব হয়েছে।
ইনডিয়ান মেডিকেল কাউন্সলের খবর নিয়েন, কী পরিমাণ ডাক্তার সনদ হারায়, জেলে যায়।
ডাক্তাররা, নিজেদের যারা নীতি নৈতিকতার খৈ ফোটান তাদের বলি- নিজের নৈতিকতা-সততা নিয়ে নিজেই একটু যাচাই কইরেন। ওষুধ কোম্পানির উপহার, বিদেশ ট্রিপ, নোট প্যাড, কলম খাতা, স্যাম্পল ওষুধ যে নেন, সেটা হালাল কি-না।
ডায়াগনস্টিকের কমিশন যারা নেন- এটা হালাল কি-না।
আরেকটা কথা, আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বলছিলেন, ইনডিয়াতে যাতে বেশি রোগী যায়, সে জন্য এ গোলমাল হতে পারে।
আপনাদের শঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। আপনারা অনেকে ইনডিয়ার ট্রিটমেন্ট বাংলাদেশের চে খারাপ বলেও তথ্য সূত্র উল্লেখ করেছেন। আমি আপনাদের তথ্য সূত্রকেও সম্মান করি।
কিন্তু যে দেশে ডাক্তার রোগীর বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই ওষুধ লেখেন, যে দেশের ডাক্তার তার প্রাইভেট চেম্বারে ১০০০ টাকার টিকেট কাটার পরেও ৩ মিনিট সময় দিতে কষ্ট হয়, সে দেশের ডাক্তারদের শোধরানোর জন্য আমাদের কথা বলতে হবে।
যদি আমার দেশের ডাক্তারের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সবল করতে না পারি, তাহলে তো মানুষ বিদেশ যাবে। দেশের রাষ্ট্র প্রধানের চোখ পরীক্ষাও সিঙ্গাপুরে হয়। বুঝতেই পারছেন, আমাদের ডাক্তারদের কতটা আস্থায় নিতে পারছি, আমরা।
ইনডিয়ায় স্থানীয়রা ভালো চিকিৎসা পান না- আপনাদের মত আমিও শুনেছি। তবে তারা বিদেশি রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছেন। চিকিৎসা এবং ব্যয় দুটোই বাংলাদেশের সেন্ট্রাল কিম্বা ল্যাব এইডের মতই! এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম। তাহলে মানুষ কেন তার সামর্থ থাকলে বিদেশ যাবে না! এখানে 'স্যার'দের গিনিপিগ থাকার জন্য।
আমরা যারা ফ্রিকোয়েন্টলি বিদেশ যেতে পারি না, তাদের কথা ভাবেন। গরিব মানুষের কথা ভাবেন- যারা হাসপাতাল'র বারান্দায় ডাক্তারের 'আদরে' মরে যান, তাদের কথা ভাবেন।
এও আপনাদের জানিয়ে রাখি-আমাদের অনেক ভালো ডাক্তার আছেন। অনেক ভালো । বিশেষত উঠতি ডাক্তারদের কথা বলছি, আমার এ রকম বহু পরিচিত ডাক্তার আছেন- যারা তার পকেটের টাকা দিয়ে রোগীর ওষুধ পর্যন্ত কিনে দেন। আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি। আর স্বপ্ন দেখি- ফেরেশতা নয় রোগী-বান্ধব ডাক্তারে একদিন আমাদের হাসপাতালগুলো ভরে উঠবে। আমরা তাদের কাছে গিয়ে আরোগ্য লাভরে সহযোগি হিসাবে দেখবো। সে দিনের আশায় থাকলাম।
শুভ স্বাস্থ্য-বাণিজ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন