রোহিংগা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের জরুরী হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে প্রফেসর ইউনূস ও আরো ২২ জনের খোলা চিঠি

রোহিংগা সংকট সমাধানে জাতি সংঘের জরুরী হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতি সংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে প্রফেসর ইউনূস ও আরো ২২ জনের খোলা চিঠি
প্রিয় নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যবৃন্দ,
আপনারা অবগত আছেন যে, জাতিগত নিধন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধতূল্য একটি মানবীয় বিপর্যয় মিয়ানমারে বিস্তৃতি লাভ করছে।
গত দুই মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে যে সামরিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তাতে শত শত রোহিংগা নাগরিক হত্যার শিকার হচ্ছে। ত্রিশ হাজারেরও বেশী মানুষ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আরো ভয়ের ব্যাপার, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে, যার ফলে আগে থেকেই চরম দরিদ্র এই এলাকাটিতে মানবীয় সংকট ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ নিকটবর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে যেখান থেকে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোন কোন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ঘটনাটিকে গণহত্যাতুল্য বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিকট অতীতে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া ও কসোভোয় সংগঠিত গণহত্যাগুলোর সকল বৈশিষ্ট্য এখানে দৃশ্যমান।
জাতি সংঘ রিফিউজি হাইকমিশনের বাংলাদেশ কার্যালয় প্রধান জন ম্যাককিসিক মিয়ানমার সরকারকে জাতিগত নিধন পরিচালনার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। মিয়ানমারে জাতি সংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লী রাখাইন রাজ্যে প্রেেবশের উপর বিধিনিষেধ আরোপকে “অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিযোগ করেছেন।

রোহিংগারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটি যারা দশকের পর দশক পরিকল্পিত প্রান্তিকীকরণ ও অমানবিক আচরণের শিকার। ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় ও তাদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়, যদিও তারা বংশপরম্পরায় মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। তাদের চলাচল, বিবাহ, শিক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মিয়ানমারের সরকার, সামরিক বাহিনী ও মিয়ানমার সমাজের অনেকেই এই দাবী করেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদেরকে তার দেশের নাগরিক বলে কোনদিন স্বীকার করেনি।
তাদের দুর্দশা নাটকীয়ভাবে ঘনীভূত হয় ২০১২ সালে যখন দু’টি ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং পাশাপাশি অবস্থিত মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিতে আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর থেকে তারা চরম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাদিপাত করে আসছে।
সর্বশেষ সংকটটির সৃষ্টি হয় ৯ অক্টোবর মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের উপর আক্রমণের একটি ঘটনায়, যাতে মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের ৯ জন সদস্য নিহত হন। এই আক্রমণ কারা, কিভাবে ও কেন করলো সে সত্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি, তবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিংগাদের একটি গ্রুপকে এজন্য দায়ী করছে। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়েও থাকে, এতে সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য সন্দেহভাজনদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচারের মুখোমুখি করা এক জিনিষ, আর হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিকের উপর হেলিকপ্টার গানশিপ দিয়ে গুলিবর্ষণ করা, নারীদের ধর্ষণ করা এবং শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে একজন রোহিংগা বলেন, পলায়নরত মানুষদের উপর তারা গুলিবর্ষণ করে। তারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাতে শুরু করে। তারা গালিগালাজ করছিল এবং নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিল।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী নারী জানান কিভাবে তাঁর দুই ছেলেকে কোন কারণ ছাড়াই আটক করা হয়: “তখন সবেমাত্র ভোর হয়েছে। সামরিক লোকজন আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। কয়েকজন ঘরে ঢোকে এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে বের করে আনে। তারা আমার দুই ছেলেকে বেঁধে ফেলে। তাদের পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়, এরপর বেধড়ক পেটানো হয়। মিলিটারীরা তাদের বুকে লাথি মারে। আমার সামনেই এটা ঘটে, আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। আমি কাঁদতে থাকলে তারা (মিলিটারী) আমার দিকে বন্দুক তাক করে। আমার অন্য সন্তানরা মিলিটারীদের কাছে হাতজোড় করে তাদেরকে না পেটাতে অনুরোধ করে। তাদের নিয়ে যাবার আগে প্রায় ৩০ মিনিট এভাবে মারধোর করা হয়।” তিনি তাঁর ছেলেদের এরপর আর দেখেননি।
দও অং সান সু’কি’র কাছে বারবার আবেদনের পরও তিনি রোহিংগাদের পূর্ণ ও সম-নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে কোন উদ্যোগ না নেয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি। দও সু’কি মিয়ানমারের নেত্রী এবং দেশটিকে সাহস, মানবিকতা ও সমবেদনার সাথে পরিচালনা করার দায়িত্ব তাঁরই।
মিয়ানমার সরকারকে মানবিক সহায়তার উপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সকল উদ্যোগ নিতে আমরা জাতি সংঘের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে মানুষ জরুরী সহায়তা পেতে পারে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদেরও সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে একটি নিরপক্ষে, আন্তর্জাতিক তদন্ত পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন।

একই সাথে জাতি সংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরী এজেন্ডা হিসেবে সংকটটিকে উপস্থাপনের জন্য আমরা নিরাপত্তা পরিষদকে বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছি এবং জাতি সংঘ মহাসচিবকে জরুরী ভিত্তিতে সামনের সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার পরিদর্শণ করতে অনুরোধ করছি। বর্তমান মহাসচিবের পক্ষে এটা সম্ভব হলে আমরা তাঁকেই সেখানে যেতে অনুরোধ করবো; অন্যথায় নতুন মহাসচিবকে জানুয়ারীতে দায়িত্ব নেবার পরই এ বিষয়টিকে তাঁর কর্ম-তালিকায় অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাবো।
আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকেও এখন এ বিষয়ে সমি¥লিতভাবে আরো বেশী সোচ্চার হতে হবে। রুয়ান্ডার পর বিশ্ব নেতারা বলেছিলেন, “আর কখনো নয়।” আমরা এখনই ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে মানুষ গুলি খেয়ে না মরলেও অনাহারে মারা যাবে এবং আমরা মানবতা বিরোধী এসব অপরাধের নিরব দর্শক হয়ে আরো একবার “আর কখনো নয়” বলার জন্য বিলম্বে হাত কচলাতে থাকবো।
স্বাক্ষরকারীদের নাম:

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৬ জয়ী
হোসে রামোস-হরতা
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৯৬ জয়ী
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৪ জয়ী
মেইরিড মাগুইর
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী
বেটি উইলিয়াম্স
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৬ জয়ী
অসকার অ্যারিয়াস
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৮৭ জয়ী
জোডি উইলিয়াম্স
নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৯৭ জয়ী
শিরিন এবাদী
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০০৩ জয়ী
তাওয়াক্কল কারমান
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী
লেইমাহ বোয়ি
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১১ জয়ী
মালালা ইউসাফজাই
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১৪ জয়ী
স্যার রিচার্ড জে. রবার্টস
চিকিৎসা শাস্ত্রে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী
এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন
চিকিৎসা শাস্ত্রে ২০০৯ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী
এমা বোনিনো
ইতালির প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রিচার্ড কার্টিস
এসডিজি সমর্থক, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, প্রযোজক ও পরিচালক
আলা মুরাবিত
এসডিজি সমর্থক, লিবীয় নারী অধিকার প্রবক্তা
পল পোলম্যান
ব্যবসায়ী নেতা
মো ইব্রাহীম
উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী
জোকেন জাইট্জ
ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী
কেরী কেনেডী
মানবাধিকার কর্মী
রোমানো প্রদি
ইতালির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী

কোন মন্তব্য নেই: