বস্তাবন্দী করে শিশু ফেলে দেয়ার জন্য ট্রলারে তোলার নজির বিহীন নৃশংস দৃশ্য জলালের গল্প সিনামাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করতে বাধ্য! এটা সমাজে ঘটে থাকতে পারে, তবে সেটা কোটিতে ১ টা ঘটনা। কোটিতে একটা ঘটনা কোনো সিনামায় উদাহরণ হতে পারবে না, সেটা আমি বলছি না। তবে অব্যাহত শিশু নির্যাতন, খুন এবং সে খুনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেবার বিকৃত সময়ে---- এমন একটি দৃশ্য শিশুদের জন্য একটা খারাপ খবর।
পরিবারে নতুন শিশু প্রত্যাশি চেয়ারম্যানের আবেগকে পুঁজি করে ভণ্ড কবিরাজের কুকর্মের সাক্ষী জালালকে 'কুফা' ঘোষণা করে সেই কবিরাজই। কবিরাজ তাকে বেঁধে রেখে সবার জন্য যে ধোঁয়া ওঠা পাত্র নিয়ে মন্ত্র পাঠ করছে, সেই একই রকমের কর্ম চালিয়ে জিন তাড়ানোর নামে শিশুটিকে বেঁধে রাখে গাছের সাথে ।
পরে তাকে বস্তাবন্দী করা হয়, সেটা নিশ্চিত ভাবে অগ্রহণযোগ্য। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি বিবাহ বহির্ভূত যৌবনজ্বালা মেটাতে গিয়ে অনেক সন্তান রাস্তায়-ডাস্টবিনে ঠাঁয় পায়। খুন হয়।
সে গল্পও সিনামায় আসতে পারে। সেটা জালালের গল্পের শুরু ও শেষের দৃশ্যটা হয়ত সিনেমাটিক বিবেচনায় মেনে নেবার মত। হাঁড়িতে করে একটা শিশুকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা কোটিতে একটা বা দুইটা। তর্কের খাতিরে আমরা এটাকে লাখে ১ টা ২ টা হিসাব করতে পরি!
গল্পটা সেকেলে, আবল তাবল বক্তৃতায় ঠাসা। সম্ভবত বিদেশের বাজারে এর কাটতি ভালো। সমাজ যে অনেক এগিয়েছে জালালের গল্প তার প্রমাণ বহন করে না। একটা স্থবির সমাজের গল্প সিনামায় ঠাসা।
আদি রস আছে। তবে সেটির উপস্থাপনা বাড়াবাড়ি ও বোকার মত।
জালালের সামনে পুরুষ মানেই নারীর শরীর ভোগ-মত্ত-উন্মাদ।
অপাপবিদ্ধ এক শিশুকে ঘিরেই যে গল্প সূচনা করেছে নির্মাতা আবু শাহেদ ইমন; সেটির বহু শব্দ অশ্লীল। বহু শরীরি ভাষা যৌনতায় ঠাসা। বহু প্রশ্ন উত্তর নিয়ে দর্শকের দুয়ারে আসতে পারেনি।
যেমনটা জালালরা কি পরিচয়হীনভাবে বেড়ে উঠে আবার পরিচয়হীনকে বাঁচাতে নদীতে ডুবে যায়! এটাই কি সিনামার মূল বার্তা।
নাকি স্থবির সমাজ কুসংস্কারে ডুবে আছে। সে সমাজে নারীর শরীর উপভোগের আয়োজনই একমাত্র অনুষঙ্গ। এটা আসল খবর!
ভিন্ন প্রশ্নও হতে পারে কারো জন্মের জন্য কাউকে মরে যেতে হয়। এটি কি কোনো্ সমাজ বাস্তবতা। এটাই কি সিনামার বক্তব্য!
কোনোটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি!
সিনামার শুরুতে সমাজের 'পানি পড়া' জাতীয় কৌতুক কৌতুহল বাস্তবতার সফল চিত্রায়ন আছে। নদীর পাড়ে পাওয়া একটা শিশু সন্তান ঘিরে গল্পের শুরুতেই কৌতুহল। শিশুটির পা ধোয়া পানি খেয়ে সবাই সুস্থ হচ্ছে। যে তাকে লালন করছে সে 'সদকা' তুলছে। সে সদকার টাকা নিয়ে প্রভাবশালীদের সাথে বিরোধের পর শিশুটির ভাগ্য একই--- নদীতে ভাসিয়ে দাও। তার পর নদীর ঢেউ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যে ঘোটে ভেড়ায়----সেখানে সে আবার বড় হতে থাকে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর বাড়িতে। চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নির্বাচনে জিতলে হলে 'পুত্র' সন্তান দরকার। সে সন্তান আগমনের জন্য কুফা জালালকে তাড়াতে হবে--- পরামর্শ কবিরাজের! সে জন্য যে নোংরা এবং নৃশংস ঘটনার চিত্রায়ণ সিনামাটিতে তা মানা অসম্ভব।
চেয়ারম্যানের স্ত্রীর জন্য 'দুধ' সরবরাহ করেন বাড়ির কাজের ছেলে। সিনামায় 'দুধ' ঘিরে অহেতুক আলাপ দীর্ঘ--- 'দুধ' শব্দটার উচ্চারণ এবং ব্যবহার যে পুরো মাত্রায় অশ্লীল এবং যৌনতার ইঙ্গিত---তা যে সব বাণিজ্যিক সিনামা অশ্লীল বলে বঙ্গ সিনামার দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেটাকেও হার মানায়!
আনমনে থাকা সদ্য ঘরে আসা চেয়ারম্যানের তৃতীয় বধূর সামনে যখন 'দুধ' শব্দটা উচ্চারণ করা হলে; 'নববধু'র মিচকা হাসি এখানে কৌতুহল জাগায়। ইঙ্গতটা এ রকম যে চেয়ারম্যানের স্ত্রী বহু পুুরুষের ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছুক!
চেয়ারম্যানের স্ত্রীর ঘরে ঢুকে ঠুসঠাস দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসাটা অনেকটা কনডমের বিজ্ঞাপনের মতই। চেয়ারম্যানের আগের দু স্ত্রীর খবর নেই। তৃতীয় স্ত্রী নিয়ে চেয়ারম্যান ঘাটে নৌকা ভেড়ান!
সন্তান জন্মদানে অক্ষম চেয়ারম্যানের শেষ চেষ্টা হিসাবে কবিরাজ আনা্ হলো। এ কবিরাজকেও দেখা গেছে ভণ্ড সাধুর চরিত্রে। বলা হচ্ছে কবিরাজ, কিন্তু সে ধুপ জাতীয় ধোঁয়া তুলে মন্ত্র জপে। হাঁস রঙ করে একটা টোটকা বানায়। এতে বেশ বিরক্ত চেয়ারম্যান স্ত্রী! তাচ্ছিল্যও তার চোখে!
এ সবের একফাঁকে কবিরাজকে দেখা যায়, চেয়ারম্যানের স্ত্রীর সাথে বাগানে। ধোঁয়া উঠছে পাত্র ভেদ করে। ঘটনার পূর্বাপর না দেখে গাঁজা চলে আসে। কবিরাজ দু'টান দিয়ে তা চেয়ারম্যানের তৃতীয় স্ত্রীর হাতে দিলে সে বেশ 'আরাম' করেই ২/৩ টান দিলো। একদিকে দেখানো হচ্ছে কবিরাজের চিকিৎসায় বিরক্ত চেয়ারম্যান পত্নী। আরেক দিকে দেখানো হচ্ছে উৎফুল্ল হয়ে গাঁজা নিচ্ছে। টানছে; হাসছে।
আরেকটি দৃশ্যও খুবই অসঙ্গত। সেটি হলো বাইরে চেয়ারম্যান স্বামীকে রেখে ভিতরে কবিরাজ তার স্ত্রীকে চিকিৎসা দিচ্ছে! চেয়ারম্যানরে মুখের উপর দরজার খিল এঁটে দিলো কবিরাজ। বাইরে অপেক্ষা করছে চেয়ারম্যান স্বামী। এমন দৃশ্য হয়ত গাঁজা আসক্তি থেকে তৈরি।
আগেকার মানুষ 'বেক্কল' ছিল; তবে এতটা না। এটা নিশ্চিত করেই বলা চলে।
সিনামাটিতে দিনের পর দিন সন্তান দেবার নাম করে কবিরাজ চেয়ারম্যান পত্নীকে ভোগ করছে। এতে আবার অতিষ্ঠ চেয়ারম্যান স্ত্রী। শেষ বার গেলে সে বলে-- 'এভাবে আর কতদিন। আপনি আটকুইরা।' প্রতি উত্তর কবিরাজের---' পুত্র সন্তান পাইবি। আরো সময় লাগবে। '
এ সব দৃশ্য জালাল জানালার ফাঁক গলিয়ে দেখে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো---
চেয়ারম্যান পত্নীর ও কবিরাজের নোংরামি একটা শিশুর চোখে দিয়ে দেখানো কতটা সঠিক! সেটা সম্ভব্ত পরিচালক ভাবেননি। উনি হয়ত শিশু সামিউলের কথা ভেবেছেন। তার মায়ের কুকীর্তি দেখার কারণে খুন হওয়া সামিউলের মত আরো অনেকের জীবন বিপন্ন হোক---এটাই সম্ভবত পরিচালকের প্রত্যাশা।
চেয়ারম্যান পত্নীর ওপর কবিরাজের নিপীড়নটা 'জায়েজ' করে দেখিয়েছে পরিচালক। সন্তান পাবার জন্য এমন নিপীড়নে চেয়ারম্যান মেনে নিচ্ছে। চেয়ারম্যান পত্নীও।
অনেকে হয়ত বলবেন---সমাজ বাস্তবতা কোনো এককালে কিংবা নব্বুই ও শূণ্যের দশকেও এমন থেকে থাকবে হয়ত। হুজুর সায়দাবাদীর মার্কেটিং করার সিনামটা যথোপযুক্ত। হুজুর সায়দাবাদীর ডিম পড়া খেয়ে নারী মা হয়েছেন। তার একটা গল্প সে সময়কার যায়ায়দিনে পড়েছিলাম। যে তাগড়া জোয়ান পোলাপাইন দিয়ে হুজুর ডিম থেরাপি দিতো।
সেটা ধরে আলাদা সিনামা হতে পারতো। এ সিনামায় চটুল সুড়সুড়ি দেবার জন্য এ রকম অসভ্য ঘটনার অবতারণা অসঙ্গত।
শেষ দৃশ্যে মোশরফ করিমকে আমরা ভিন্ন চরিত্রে দেখি। তবে এখানেও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক । সংলাপেও একটা অশ্লীল ধারা। যাত্রার নতর্কীকে বিয়ে করাটা অসঙ্গত সে কথা উঠে আসে মোশরফের কণ্ঠে। একটা নারীকে আটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ এবং সন্তান সম্ভাবনা হওয়ার পর কুৎসিত প্রশ্ন --- বাচ্চা কার? আমার (মোশারফ করিম), জালালের না অন্য কারো।
বাস্তবতা 'নরম' না 'শক্ত' সেটায়ও একটা অশ্লীল ইঙ্গিত!
মজার ব্যাপার হলো সিনামাটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে জোড়াতালি দিয়ে একটা কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা। এ দাঁড়ানোটা অশ্লীলতা আর নৃশংসতার উপর ভর করে। এ ভর কোনোভাবেই সুস্থ সিনামার জন্য ভালো খবর নয়।