উপেক্ষা করতে পারাটাও এক ধরণের সাহসের ব্যাপার। সে সাহস সরকারি দলের আছে। শীর্ষ থেকে নিম্ন সব পদের লোকই গণমানুষের আশা আকাঙ্খাকে উপেক্ষা করছে-- উপহাস করছে। মানুষ সেটি অসহায়ভাবে দেখছে--- ভাবছে এ দিন কবে ফুরাবে। সে ফুরানোর জন্য অন্য কারো ক্ষমতায় আসার দরকার--- তার চেয়ে বড় কথা ক্ষমতাবানদের শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া দরকার।
কারণ নিশ্চিতভাবে এদেশের সব মানুষ ' হিজরত ' করবেন না । এখানেই থাকবেন। থাকবেন বলেই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য রাষ্ট্র তৈরি করার সবারই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে--- যে যেখানেই আছেন; সেখান থেকে এর চেষ্টা হতে পারে। এ জন্য বিশিষ্ট উদ্যোগের দরকার আছে--- তবে সেটি না হলে যে কাজ মোটেও এগুবে না--- তা বিশ্বাস করতে চাই না।
'শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড'--- ছোটবেলায় পড়েছি। বড় হওয়ার পর দেখছি এটা ভুল! কারণ মেরুদণ্ড যদি শিক্ষাই হবে--- তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে রাজনীতি করা লোকেরা শিক্ষকদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করেন কীভাবে। তারা কীভাবে বলেন-- অনেক পেয়েছেন; এবার থামেন। তিন চার জায়গায় পড়ান , সব কামাইয়ের খবর আছে। কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে টাকা কামান। চাকুরীর দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নেন লাল লাখ কোটি কোটি টাকা।
তিন চার জায়গায় পড়ানোর শিক্ষক আসলেই আছে--- এটা মিথ্যা নয়। তবে সেটি কত সংখ্যক ; সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। সে প্রশ্নটাই আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এটা নিয়ে কথা ভাবার লোকটি এখন শিক্ষামন্ত্রী। যিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান কলাম লেখক--- তবে সরকারের বাইরে থেকে জ্ঞান বিতরণ আর ভেতরে থেকে বাস্তবায়নের তফাৎটা তিনি এখন বুঝছেন হয়ত!
প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্ক তার কপালে চকচক করছে। এ চককে কলঙ্ক আমাদের মেরুদণ্ড তৈরিটাকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। জাতি কিছু মেরুদণ্ড হীন কর্পোরেট দাস পাচ্ছে--- কিছু অনুগত সম্বাদিকও পাচ্ছে। কর্পোরেট দাসরা দেশের স্বার্থের চেয়ে সাময়িক প্রাপ্তিতে উত্তেজিত। আর সম্বাদিকরা ---- একটা কঠিন স্বপ্ন নিয়ে বাম রাজনীতিকদের মত জীবন শুরু করে মাঝপথে জীবন বাস্তবতায় থমকে থাকেন; মাথা নুয়ে কথা বলেন। রাজনীতিকদের অুনগত হন আর সত্য প্রকাশে ভীরু হয়ে পড়েন। বলে কী লাভ জাতীয় বয়ান তাদের মুখে।
তবে দু ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম তো আছে। না হলে আমরা টিকে আছি কীভাবে।
একটি সুপার স্টোরে আজ সকালে একটা ছোটদের গল্পের বই পড়ছিলাম-- তাতে পিতা তার মৃত্যুর আগে তিনপুত্রকে ডাকলেন। প্রথমজনকে আটার কল। দ্বিতীয়জনকে গাধা এবং শেষ জনকে বিড়াল উপহার দিলেন--- বিড়াল পেয়ে বেদনাহত ছোট পুত্র। ভাবছিলেন তিনি এ বিড়াল দিয়ে কী করবেন? বিড়াল তাকে বুদ্ধি বাতলে রাজকন্যার সাথে বিয়ের বন্দোবস্ত করে দিল--- সে এক বিরাট ইতিহাস বটে।
এ সব রূপকথার গল্প এখন সত্য! কখনো কখনো অতি সত্য। কারণ জগত চলছে 'চালাকি'তে। সে চালাকি করে কে কত উপরে উঠবে সেদিকেই নজর।
এতে দোষের কিছু আছে বলে আমি সেটার দাবি করতে চাচ্ছি না।
আমার কষ্টের জায়গাটা ভিন্ন। শিক্ষকদের বেতন আর আমলাদের বেতনের মধ্যে একটা ফারাক থাকছে। এতে শিক্ষকরা মর্মাহত। প্রাথমিক শিক্ষকরা দেখলাম রাস্তায় ঘুরছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক পিতা তাদের সন্তান হারিয়ে কাঁদছেন। একজন বলছেন, 'বিচার চাই না। ' তার এ প্রতিবাদের ভাষাও বুঝতে পারেনি আমাদের অক্ষম রাজনীতি।
আমরা সবাই বলছি--- এ অস্বাভাবিক কি হে।
নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়! এড়ায় না। তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই না; নগর পুড়ছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই শিক্ষকরা তার প্রাপ্য সম্মান পাবেন।
সেটা যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন।
বছর কয়েক আগে খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ির এক চা দোকানের কোনায় বসে কথা হচ্ছিল--- দশরথ চাকমার সাথে। লম্বাটে চোয়ল আর তীক্ষ্ণ চোখ। হাসতে হাসতে বললেন-- দা্দা ছেলেপুলেকে পড়িয়ে চাকুরী দিয়ে দেন; অশান্তি থাকবে না। এরশাদ সরকারের সময় উপজেলায় চেয়ারম্যান ছিলেন দশরথ। বললেন--- ঠিক মত পড়াতে পারিনি বলে আমার ছেলে এখন গাড়ি চালিয়ে জীবিকা অর্জন করছে। তবে আমি তাকে সুশিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছি--- 'শ্রম দিয়ে খাও।' শ্রম না দিয়েও অনেক উপার্জনের ব্যবস্থা আছে।
আমি আমার সন্তানদের সেটা উপেক্ষা করতে শিখিয়েছি।
দশরথরা দেশের আনাচে কানাছে আছেন; তাদের জাগিয়ে দিন--- শিক্ষকদের সম্মানটা দিন। নৈতিক শিক্ষা; অন্যায় অবিচার নিয়ে প্রাণ খুলে কথা বলতে দিন তাহলে চাপাতি, বন্দুক , পেট্রোলবোমা আর রক্তারক্তির অবসান হবে।
আসুন আজ যে শিশু পৃথিবীতে এসেছে তার তরে আমরা একটা সাজানো বাগান রচনা করি। আমরা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে না শুনতে হয় তোমরা সব লুটেছো; তার মাশুল দিচ্ছি আমরা। শুভ হোক সবার প্রতিক্ষণ।